শনিবার- ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১৫ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
পাহাড়ে বারহি জাতের খেজুর চাষ করে স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখালে নুর আলম

পাহাড়ে বারহি জাতের খেজুর চাষ করে স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখালে নুর আলম

বিটন চৌধুরী, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি। ১৯৯৭ সালে চাঁদপুর মতলব সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন নুর আলম। এর পর দীর্ঘ বছর ধরে সৌদি-বাংলাদেশে আইটি সেক্টরে কাজ করতেন তিনি। এক দিন পাহা‌ড়ে ঘুর‌তে এ‌সে পাহাড়ের প্রকৃতির প্রেমে পড়েন। সেখান থেকে ব্যতিক্রম নুর আলম। মাটি ও আবহাওয়া পাহাড়ি অঞ্চলে বিদেশী খেজুর গাছে ভালো ফলন ফলানো সম্ভব কিনা তখন তা নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না নুর আলমের। বিভিন্ন দেশ থেকে খেজুর চাষের পরামর্শ নেন। পাহাড়ে বিদেশী জাতের বারহি খেজুর চাষ করে স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখালে মোঃ নুর আলম। যা খাগড়াছড়িতে প্রথম ফলান তিনি।

খাগড়াছ‌ড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের পূর্ব দিকে পাহাড়ি আকাঁবাকাঁ উচুঁ-নিচুঁ চার কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে রসুলপুর পাড়া। পাড়ার ছোট টিলার মধ্যে ছোট ছোট খেজুর গাছ। একটু সামনে গেলেই চোখজুড়ানো হলদে রঙের পাকা খেজুর থোকায় থোকায় ঝুলে গাছে। এই দৃশ্য দেখে যে কারো মনে হবে পাহা‌ড়ের বু‌কে যেন একখন্ড মরু দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশি‌ খেজুর নান্দ‌নিক দৃশ্য মা‌তোয়ারা ক‌রে তো‌লে যে কা‌রোর মন‌।

টিলার মধ্যে বারহি জাতের বিদেশি খেজুরের চাষ করে সফলতার দেখাচ্ছেন খেজুর চাষি মোঃ নুর আলম। তার বাগান এক নজর দেখতে দূর-দূরান্ত থে‌কে প্রতিদিন ছুটে আসে অসংখ্যা মানুষ।

খেজুর চাষি মো. নুর আলম বলেন, আগে আইটি সেক্টরে কাজ করতাম। কৃষির বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখে দেখে আমার আগ্রহ জন্ম যায়। চিন্তা করলাম কিসের বাগান করা যায়। এমন একটা ফলের বাগান করতে হবে যে বাংলাদেশের ১০০% আমদানী নির্ভর। আর ওই ধরণের ফলের বাগান করলে আমরা কিছুটা হলে যোগান দিতে পারি আমদানির ঘাটতি কমানে পারি তা হলে আমাদের দেশের ডলার সেভ হবে। এই উদেশ্য করে আমি খেজুরের চারা দিয়ে স্ট্যাটাস করি টিস্যু কালচার। প্রথমে ২৫টি চারা দিয়ে স্ট্যাটাস করি পরর্বতীতে আরো ৭৫টি চারা দিয়ে মোট ১শ টিস্যু কালচার বাগান স্ট্যাটাস করি। গাছের বয়স হচ্ছে তিন বছর সাত মাস। ২০১৯ সালে ডিসেম্বরে রোপন করি। আমার ২৫টি গাছের মধ্যে ২৪টি গাছে ২০২২ সালে প্রথম ফলন পাই। ২০২৩ সালের ফল বিক্রি শুরু করেছি। প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি করছি। মাটিরাঙ্গায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বাহিরে দিতে পারছি না।

তিনি বলেন, বাগানের সামনে আরো এক একর খালি রেখে প্রস্তুত করেছি শুধু এই খেজুরের চারা লাগানোর জন্য। অনেকেই সত্যকে প্রকাশ করে না খেজুর ফেটে যাচ্ছে বাংলাদেশের সব জায়গায়। আমার গত বছর খেজুর ফেটে গেছে আমিও ভেঙে পড়ে গিয়েছিলাম না আর খেজুর গাছ লাগাব না। তার পরবর্তীতে গত এক বছর গবেষণা করার পর বিভিন্ন ভাবে কি করা যায় খেজুর ফাটা রোধ করার জন্য তিনটা ফর্মুলা প্রয়োগ করার পর এই বছর আমার ১% ফাটে নাই। একবারেই ফ্রেশ ফল হয়েছে। যার কারণে আমার সামনে আরো এক একর জায়গাতে দ্রæত খেজুর টিস্যু কালচার দিচ্ছি। পরিকল্পনা হচ্ছে আরো একশ চারা গাছ দিয়ে বাড়ানো।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সবুজ আলী বলেন, পৌরসভার রসুলপু‌র এলাকায় টিলায় নুর আলম পরীক্ষামূলকভা‌বে ১ একর জ‌মি‌তে খেজুর চাষ করছেন। ‌গত দুই বছর ধরে গাছে ফলন দিচ্ছে। গত বছর তুলনায় এই বছর ভালো ফলন হয়েছে। গাছের ফল দেখে পাহাড়ে আশা জাগাচ্ছে খুব ভা‌লো। পাহা‌ড়ের মা‌টি‌তে বিদেশী জাতের খেজুর এক‌টি সম্ভাবনাময় ফল।

চাষি নুর আলম বলেন, বিশ্বে খেজুর উৎপাদনের জন্য চতুর্থ থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশের আবহাওয়া কাছাকাছি। তাহলে থাইল্যান্ড যদি চার নম্বর খেজুর উৎপাদনকারি দেশ হতে পারে অমরা কেন পারব না। একেই আবহাওয়া হওয়ার পরে। আমরা এর আগে সরকার এবং উদ্যোক্তারা ওই ভাবে পরিকল্পনা করে এগিয়ে যায়নি। আশা করা যাচ্ছে দ্রæত ব্যাপকহারে বাংলাদেশে খেজুর চাষাবাদ বেড়ে যাবে। কারণ থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশের আবহাওয়া এক। খেজুর উৎপাদনের জন্য কোন সমস্যা হবে না।

খেজুর চাষি নুর আলম জানান, ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথমে ফুল আসে এবং আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে ফল সংগ্রহ করা শুরু করি। বাগানে মিশরী বারহি, আজওয়া, মিরজন আম্বার চারটি জাত। পৃথিবী ব্যাপি খাওয়ার জন্য বারহি জাতের খেজুর বিশ্বে বিখাত। সবচেয়ে বেশি ফল দেয় বারহি। বারহি খেজুরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে পাকার পর শুকানোর প্রয়োজন নেই। মিশরী বারহি এটাকে কাঁচা খাওয়ার জন্য বিশ্ব বিখাত।

মো. নুর আলম বলেন, তিন বছর সাত মাস বয়সি খেজুর গাছ। দুই সিজন ফল এসেছে আর তিন সিজন ফল আসার পর পর এক একটি গাছ ১৫০ থেকে ২০০ কেজি ফল দিবে। বারহি জাতের খেজুর এটি বিশ্ব বিখাত। পৃথিবীর সব জায়গায় খেজুর নিয়ে কাজ করে তারা কিন্তু এ বিষয় নিয়ে জানে। বারহি জাতের খেজুর উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি। একটি গাছে ১৫০ থেকে ২০০ কেজি ফল দেয়। বর্তমানে একটি গাছে ২৫ থেকে ৩০ কেজি ফল পাচ্ছি। এই বছর খেজুর বিক্রি করে ২ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পাব বলে আশা করি।

বিদেশী খেজুর চাষ বিষয়ে খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, মাটিরাঙ্গা উপজেলায় সৌদি খেজুরের চাষ হচ্ছে। এই খেজুর পাকলে হলুদ রঙের হয়। গোল আকৃতি এবং খেতে মিষ্টি। এখানকার মাটি এবং আবহাওয়া খেজুর চাষে উপযোগি। ভবিষ্যৎতে আমরা খাগড়াছড়িতে খেজুর চাষের সম্প্রসারণের উদ্যোগী হব এবং চাষি কিভাবে চাষ করতে এই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হবে।

খাগড়াছড়ি খেজুরবাগান হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-সহকারি হর্টিকালচার অফিসার সুজন চাকমা বলেন, আরব দেশ থেকে খেজুর আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটাতে হয়। দেশে খেজুরের চাহিদা প্রচুর। আমাদের দেশের লোকজনের সাথে খেজুরের সম্পর্ক আছে। চাষি নুর আলম বারহি জাতের খেজুর গাছ লাগিয়েছেন ফলন ভালো হচ্ছে এটা সম্ভানাময়। এই খেজুর খেতে সুস্বাদু। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এই জাতগুলো সংগ্রহ করে গবেষণা করা দরকার। এই সমস্ত নতুন নতুন জাত উৎপাদন করে সম্প্রসারণ করার দায়িত্ব আছে। নজর দেওয়া উচিৎ।

পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন, নতুন ফল হিসেবে কৃষককে এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায়। বারহি, আজওয়া, মিটজল ও আম্বার জাতের এক-দুই বছর ফলন পাচ্ছে পরর্বতী না পেতে পারে। পেলে গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে যাবে। মরুভুমির ফল। যেখানে বৃষ্টিপাত কম হয় সেখানে ভালো ফলন হয়। খেজুর চাষ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে হয়নি। খেজুর আমরা বিদেশ থেকে আমদানী করি। যদি খাগড়াছড়িতে খেজুর উৎপাদন করা সম্ভব হয় সেটা আমাদের জন্য সুখবর।

তিনি বলেন, বারহি জাতটি সফলতা অর্জন করে এই জাতটি নিয়ে আমরা গবেষণা করে দেখব।

১৩৭ বার ভিউ হয়েছে
0Shares