মঙ্গলবার- ১৮ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঋণ পরিশোধ করতে না পারা বিষপানে ‌‌ব্যবসায়ীর মৃত্যুর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম

ঋণ পরিশোধ করতে না পারা বিষপানে ‌‌ব্যবসায়ীর মৃত্যুর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম

স্টাফ রির্পোটার : ‘ হে এক লাখ দশ হাজার টাকা পায়, মানষের কাছে কইছে দুই লাখ টাকা পায়, তিন চার বছর ধরিয়া টাকার লাভই লাভই দিয়া গেছি, আমার দুই কাঠা ক্ষেত রাখছিলাম, আমার দুইটা ছেরারে ইটখোলার কামে দেছি, দুই কাঠা জমির বেচার টাকা ও দুই ছেরার ইটখোলার কামাইয়ের টাকা দিছি, গাভীন গরুটারেও নেছে গা, অন গরুর কথাটা আলাপ করে না, হে খালি মানষের কাছে কয় টাকা টাকা পায়, বাদে আমার বেটা বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করেছে আমার পোলাপান ডিরে থুইয়া, আমদার অন এক শতাংশ মাটি নাইঘা, আমরা শেষ, সব হারাইলাম, আমনে গরতে এই বিচারডা চাই ‘। পাওনাদের চাপে বিষপানে স্বামী রমজানের মৃত্যুর কথা জানাতে গিয়ে আহাজারি ও বিলাপ করে একথাগুলো বলছিলেন মৃতের স্ত্রী শাহানা আক্তার ।

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় পাওনাদারদের চাপের মুখে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে রমজান আলী নামে এক গরু ব্যবসায়ীর মৃত্যু ঘটনায় মৃতের বাড়ীতে চলছে শোকের মাতম। নিজ বাড়ির পাশে ছটফট করতে দেখেন তার স্ত্রী শাহানা আক্তার । উদ্ধার করে কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন কর্তব্যরত  চিকিৎসক।

গত সোমবার উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের ব্যস্তপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। গত বুধবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়  মারা যান তিনি । মৃত রমজান আলী উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের ব্যস্তপুর গ্রামের আবুল হোসেন ও আমেনা খাতুন দম্পতির ২য় পুত্র সন্তান । তিনি স্থানীয় বাজারে গরুর ব্যবসা করতেন। মৃত্যুকালে এক স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়েসহ রেখেছেন।

সরেজমিনে গেলে স্থানীয় ও  মৃত পরিবারের লোকজনের সাথে কথা জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রমজান স্থানীয় বাজারে গরুর ব্যবসা করতেন। সামান্য পুঁজিতে ওই ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে সংকটে পড়েন তিনি। এর ফলে স্থানীয় ব্যক্তি দাদন ব্যবসায়ীসহ একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। এতে করে মুনসুর নামের ব্যক্তির দুই লক্ষ ১০ হাজার টাকাসহ প্রায় দশ লক্ষাধিক টাকার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পাওনাদারদের সুদ ও আসল টাকা পরিশোধ করতে না পেরে চাপের মুখে পড়েন। এতে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে বাড়ী ছেড়ে পালিয়েও বেড়াতেন। পাওনাদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশী মানসিক চাপ প্রয়োগ করেছেন মনুসুর নামে ব্যক্তি। অন্য পাওনাদারের চাপ না থাকায় রমজানের পরিবারসহ তাদের লোকজন নাম বলতে পারছেন না। বিষপানের একদিন আগে গত রবিবার ব্যস্তপুর গ্রাম থেকে মাঠে ঘাস খাওয়া একটি গাভীন গরু ( যার মূল্য ৭০-৮০ হাজার টাকা) নিয়ে যান পাওনাদার মুনসুরসহ তার লোকজন। বিষপানে রমজানের মৃত্যুর ঘটনায় পাওনাদার মনসুরসহ পাওনাদের অমানবিক চাপকে দায়ী করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানিয়েছেন তার পরিবারসহ স্বজনরা।

এবিষয়ে মুনসুর নামে স্থানীয় পাওনাদার এলাকায় না থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তার বড়ভাই গনি মিয়ার সাথে কথা হলে সাংবাদিকদের জানান, মুনসুর  রমজান আলীর নিকট দুই লক্ষ টাকা পায়।  পাওনার টাকার জন্য  কোন ধরণের চাপ দেয়নি তার ভাই  এবং ওই গরুটি তার ভাইয়ের। রমজান পরিবারের কাছে গরুটি আদি দেওয়া ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

মৃত রমজানের চাচা মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, গত সোমবার সন্ধ্যায় মুনসুর নামে লোকটা আমাদের বাড়িতে এসে বলে তোমরার এখানে বসা যাবেনা। কেন? তোমরার বাড়ীতে দুই লক্ষ দশ হাজার টাকা পাইতেছি।  কার কাছে?  তোমরার রমজানের কাছে। বাড়ী থেকে মুনসুরের যাওয়ার পর শুনি ওইদিন রাতেই আমার ভাতিজা রমজান বিষ খাইছে।

মৃত রমজানের বাবা আবুল হোসেন সাংবাদিকদের  জানান, আমার ছেলের সাথে লেনাদেনা আনছে। আমার সঙ্গে আজ পর্যন্ত কেউ আমার কাছে বলছে না। তবে রমজান যে বিষ খাইছে ওইদিন একটু আগেই মুনসুর আমার বাড়ীতে আইছে। ছেলে বিষ খাইয়া মারা গেছে এর জন্য মুনসুরের আমি সূক্ষ্ম বিচার চাই।

উপজেলার শিক্ষক অঞ্জন সরকার বাবন সাংবাদিকদের বলেন , দাদন ব্যবসা আমাদের সমাজের একটি ব্যাধি এটা। দীর্ঘদিন যাবত  বাজে ব্যাধিটি সমাজে  চলে আসছে। প্রতিদিনই এই ব্যাধিটির শিকার হয়ে সর্বশ্রান্ত হচ্ছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষ কেউ নিজের জীবনও দিচ্ছে। সর্বশেষ প্রমাণ হচ্ছে কলমাকান্দা সীমান্তবর্তী ব্যস্তপুর গ্রামের রমজান আলী। সে দাদন নিয়েছিল নিজের জীবনের তাগিদে। পরিশোধের কোন উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথটিকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমরা অত্যন্ত মর্মাহত এই ঘটনায়। সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি ও রাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করবো যদি আইন করে এ ব্যাধি থেকে মানুষ ও সমাজকে রক্ষা করা যায়। তাহলে এ সমাজ অনেকাংশে ভালো থাকবে। আমরা চাই রমজান আলির মত পরিণতি আর কারো না হয় এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

এ ব্যাপারে কলমাকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ  (ওসি) আবুল কালাম (পিপিএম) সাংবাদিকদের বলেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে  ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে রমজানের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে বুধবার কলমাকান্দা থানায় বিষপানে রমজান আলীর মৃত্যুর ঘটনায় মৃতের বাবা আবুল হোসেন  একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছেন।

৪০ বার ভিউ হয়েছে
0Shares