শনিবার- ১৫ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১লা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অবহেলিত এক মঞ্চ শিল্পীর দায়িত্ব নিলেন নাটোরের জেলা প্রশাসক আপ্লুত ললিতার চোখে আনন্দাশ্রু

অবহেলিত এক মঞ্চ শিল্পীর দায়িত্ব নিলেন নাটোরের জেলা প্রশাসক আপ্লুত ললিতার চোখে আনন্দাশ্রু

ইসাহাক আলী, নাটোর, ১৬ নভেম্বর- ; এক সময়ের মঞ্চ মাতানো অভিনয় শিল্পী ললিতা অবহেলার শিকার হয়ে মানবেতর জীবন করার খবরে তার সার্বিক দায়িত্ব নিলেন নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। বুধবার বিকালে তিনি তার কার্যালয়ে ললিতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার খোঁজ নেন তিনি। পরে তিনি তার সার্বিক দায়িত্ব নেয়ার আশ্বাস দেন। এ সময় জেলা প্রশাসক তাকে নগদ ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।  এছাড়া তিনি ভূমিহীন হওয়ায় তাকে আশ্রয়ন প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘর প্রদানেরও আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।  এ সময় আবেগে আল্পুত ললিতা আনন্দে কেঁদে ফেলেন।

জেলা প্রশাসকের মানবিকতার প্রশংসা করেন এক সময়ের সুনিপুন অভিনয়ের এই কারিগর। তিনি বলেন, দেশে মঞ্চ নাটক ও যাত্রার দূর্দিনে তার মতো অনেকের জীবনই এখন অবহেলার শিকার। তাই অভিনয় করে এক সময় জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন নাটক যাত্রার চাহিদা না থাকায় তাদেরও কদর নেই। অর্থাহার অনাহারে চলে তাদের দিনানিপাত। এমন দূর্দিনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় কৃতজ্ঞতা জানানোর সাথে সাথে যাত্রা নাটক রক্ষার সরকারী উদ্যোগেরও দাবি করেন তিনি।

এ সময় জেলা প্রশাসক বলেন, দেশের ঐতিহ্যের ধারক যাত্রা নাটকে যারা অভিনয় করতেন তাদের অবহেলা কখনোই কাম্য নয়। বিষয়টি তার নজরে আসায় তিনি এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। কোন শিল্পীই যেন সমাজের অবহেলার পাত্র না হন সে ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু সরকার বা প্রশাসন নয় সমাজের বিত্তবানদেরও নাগরিক দায়িত্ব থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তার দায়িত্বকালিন সময়ে জেলার কোন শিল্পীই যেন এমন অনাদরে দিন না কাটান, সে ব্যাপারে তিনি খোঁজ খবর রাখবেন। তার অগোচরে এমন কেউ থাকলে তা সংবাদকর্মি ও সংশ্লিষ্টদের তাকে অবহিত করার আহবান জানান।

ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে  ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন অভিনয় শিল্পী ললিতা রানী। পিতা খোকন ও মাতা উমা রানীর ঘর আলোকিত করে তিনি এসেছিলেন পৃথিবীতে।  ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ললিতার বয়স ছিল ১৩ বছর। জীবন যুদ্ধে লড়ে যাওয়া ললিতার পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তার ঠাঁই হয়েছিল ফুপুর সংসারে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ফুপুর মৃত্যুর পরে সংগ্রামী এই অভিনেত্রীকে ভিটাছাড়া হতে হয়। অভাব অনটনে জর্জরিত ললিতার কপালে জোটেনি লেখাপড়ার সুযোগ। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছিলেন যাত্রাদলে। অশিক্ষিত হলেও স্মরণশক্তি ভালো থাকায় যাত্রার সংলাপ খুব দ্রুতই মুখস্ত করতে পারতেন তিনি। সহকর্মী এক অভিনেতার সঙ্গে জীবন সংসার শুরু করেন তিনি। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীনের পরে ফরিদপুর থেকে স্বামীর সাথে নাটোরে চলে আসেন। তার পর থেকেই বাস করেন শহরের উত্তর পটুয়াপাড়া এলাকায়।  আর্থিক স্বচ্ছলতার সময় থাকতেন ভাড়া বাসায়। এখন একটি খাস জায়গায় তার দিন কাটে অনেইটাই খোলা আকাশের নিচে।  সেটাও কাজের প্রয়োজনে সেই ঝুপড়ি ঘরটি মাপজোঁক করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। একদিনে পেটের চিন্তা অন্যদিকে মাথার উপরের আকাশটাও হারানোর ভয়ে দিন কাটে মঞ্চ মাতানো ললিতার।

নাটোরের সংস্কৃতি কর্মিরা জানান, এক সময়ে মঞ্চ কাপানো উত্তরবঙ্গের সেরা অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনি তার নামটি উল্লেখযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে সেই সুনাম আর সুখ্যাতি তাকে দিতে পারেনি স্থায়ী প্রশান্তি। রোগশোকে আক্রান্ত স্বামীর মৃত্যুর পরে জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। তবে মনে জোড় আর সাহস এবং গলার দরাজ কন্ঠে শব্দের সুস্পষ্ট উচ্চারণ ধ্বনিত হলেও বিলুপ্তপ্রায় যাত্রাশিল্পে পরে কর্মহীন হয়ে পড়েন তিনি।

এখন রোদে পুড়ে শরীরের রং তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। কিছুটা জলেও ঝুলে গেছে তার গাল দুটি, কুঁচকে গেছে শরীরের চামড়া। মাথায় চুল গুলো অনেকটা শরতের মেঘের মত সাদা।

একমাত্র সন্তানটি বিয়ে করে আলাদা জীবন যাপন করে। এক সময় বেসরকারী ক্লিনিকে পরিচ্ছন্ন কর্মির কাজ করলেও বয়সের ভারে তাও ঠিকমতো করতে না পারায় চলে গেছে আয়ের মাধ্যমটিও। ফলে অন্যের দ্বার হাত পেতেই সময় কাটাতে হতো তাকে।  যার অভিনয়ে এক সময়ে দুই হাতে করতালির ফোঁয়ারা ফুটাকতো মানুষ সেই মানুষগুলোই তার হাতে সামান্য অন্য বা সাহায্য তুলে দিতে এগিয়ে আসেনি।

ললিতা জানান, বয়স্ক ভাতার জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম কাউন্সিলর বলেছেন বয়স্ক ভাতা পাওয়ার বয়স আমার হয় নাই। অসচ্ছল সংস্কৃতিক শিল্পী হিসেবেও আবেদন করেছিলাম, তারও কোন আশ্বাস পাইনি।

ললিতার জীবনের সেই করুণ পরিণতি নাঁড়া দিয়েছে জেলা প্রশাসককে। কিছু আর্থিক অনুদানের সাথে সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণের আশ্বাসটি পরিপূর্ণতা পেলে ললিতারা আর সমাজের বোঝা হবে না।  তাই ললিতাদের মতো অন্যদেরও খুজেঁ বের করে একটু হলেও খেয়েপড়ে বাঁচার মতো নিশ্চয়তাই হতে পারে প্রকৃতভাবে শিল্পীর প্রকৃত মূল্যায়ন এমনটাই মনে করেন সংস্কৃতিবোদ্ধাসহ সংস্কৃতি কমির্রা।

৩৬৭ বার ভিউ হয়েছে
0Shares