শনিবার- ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১৫ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ভোলায় জাটকা নিধন – ৩০০ টাকায় ১০৫ ইলিশ

ভোলায় জাটকা নিধন – ৩০০ টাকায় ১০৫ ইলিশ

ভোলা প্রতিনিধিঃ ভোলার বিভিন্ন স্থানে অবাধে কেজি দরে ও ভাগা দিয়ে জাটকা বিক্রি করছেন জেলেরা। ৩০০ টাকায় কমপক্ষে ১০৫টি জাটকা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। চলতি প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ বেশি ডিম ছেড়েছে,তাতে নদীতে জাটকার সংখ্যাও বেশী, আর জেলেদের জালে ঝাকে ঝাকে ধরা পরছে জাটকা,কিন্তু জাটকা সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নেই। এতে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরন নিয়ে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাটকাকে একটি বড় ইলিশে পরিণত করতে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও মৎস্য বিভাগের অবৈধ লেনদেন, লোকবল ও অর্থসংকটের কারণে তা ভেস্তে যাচ্ছে। বর্তমানে জেলেরা ট্রোলার ভরে জাটকা নিধন করে চলেছে।

সরজমিনে ২৬ জানুয়ারী থেকে ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত ভোলার মেঘনার পাড়ের বিভিন্ন মাছ ঘাট ঘুরে জেলে, স্থানীয় ও জেলে নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ভোলার কয়েকজন জেলে নেতা বলেন, জাটকা সংরক্ষণের জন্য আট মাস (নভেম্বর-জুন) মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারির নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে নদীতে অভিযান নেই বললেই চলে। অবৈধ কারেন্ট জাল দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে হাজার মেট্রিক টন জাটকা ধরা পড়ছে। তবে প্রতিদিন জাটকা ধরার পরিমাণ এত নয় বলে দাবী করেছে মৎস্য বিভাগ। তারা বলছে, প্রতিদিন ২০০ মেট্রিক টন জাটকা ধরা পড়ছে। এসব জাটকা নিধন করছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পালিত জেলেরা। এই মাছ বিক্রির টাকা ৪ ভাগে ভাগ করা হয় বলে জানান জেলেরা। যার সাথে মৎস্য বিভাগের কর্তারা, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, নেতা ও জেলেরা জড়িত বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

জাটকা নিধন বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ না নিতে পারার কথা স্বীকার করে মৎস্য বিভাগ বলছে, প্রতিদিন একবার অভিযান চালাতে গেলে ভোলার সাত উপজেলায় কমপক্ষে এক লাখ টাকা দরকার। সেখানে আট মাসেও এক লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া লোকবল সংকটের কারনে সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।

এক মৎস্য নেতা জানান, প্রজনন মৌসুমে (১২ অক্টোবর-২ নভেম্বর) সাগর থেকে নদীতে উঠে আসা ইলিশের মধ্যে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ মা ইলিশ সফল ভাবে ডিম ছেড়েছে। ওই ডিম জাটকায় পরিনত হওয়ার ফলে জেলেদের জালে ঝাকে ঝাকে জাটকা ধরা পরছে, মাছ জব্দ করে জাটকা ধরা বন্ধ করা যাবে না। নদীতে নেমে ভয় দেখালে জেলেরা জাটকা শিকারে নামবেন না। আর র্দূনীতিবাজ মৎস্য কর্মকর্তাদের অনৈতি কাজে সহযোগীতা বন্ধ করতে শুধু বদলী করলেই চলবেনা, তারা যেখানে যাবে সেখানেই র্দূনীতি করবে। জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে হলে উচিত হবে তাদের চাকুরি থেকে অব্যহতি দিয়ে শাস্তির আওতায় আনা, একজনের শাস্তি দেখে শতজন শতর্ক হয়ে যাবে। যদি জাটকা অবৈধ জালে শিকার হয়ে যায়, তাহলে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।

ভোলা মৎস্য বিভাগ জানায়, ভোলায় চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন, আর দেশে ৬ লাখ মেট্রিক টন। সারা দেশে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। আর ভোলায় গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৩ মেট্রিক টন। ভোলায় গত আড়াই মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ আহরণ হয়েছে।

ভোলার ৫০টি মাছঘাটের ২০০ জেলে, আড়তদার ও জেলে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলায় যদি প্রতিদিন ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা হয়, তাহলে তার মধ্যে জাটকার পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টনের (৮০ শতাংশ) বেশি।

তবে জেলা মৎস্য বিভাগ এই তথ্য মানতে নারাজ। সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ নাজমুস সালেহীন বলেন, প্রতিদিন মোট আহরণের ৪০ শতাংশ (২০০ মেট্রিক টন) জাটকা হতে পারে। কোস্ট গার্ডের অভিযানে জব্ধ করা বড় চালানের জাটকা আটকের পরে তারা উল্লাসিত হয়ে গর্ভের সাথে বলে ৫০ টন জাটকা আটক করা হয়েছে। জাটকা ধরার আগে তারা কোথায় ছিলেন, তাদের এ গর্ভ জাতীয় সম্পদ ইলিশ হারিয়ে যেতে উৎসা করছে বলে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন।

ভোলা খালের মাথা মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জাটকার মেলা বসেছে। পাইকার মাছ কিনে বরফ দিয়ে বাক্সে ঢোকাচ্ছে। এক পাইকারের বাক্সে দেখা যায়, নানা প্রজাতির মাছের পোনা ও জাটকা। মাছগুলো এত ছোট যে এক কেজিতে শতাধিক মাছ হবে। এক কেজি মাছের খুচরা দাম ৩০০ টাকা। ঘাটে আরেকটি বাক্সের ওপর বসানো টিনের থালায় আরও ছোট ছোট মাছের পোনা, ইলিশের জাটকা দেখা যায়। এ জাটকা সাধারণত অবৈধ পাই ও বেহুন্দি জাল দিয়ে ধরা হচ্ছে। এ মাছ বড় হলে ৫০ লাখ টাকা বিক্রি হতো বলে জানান এক দালাল। তার কিছুক্ষন পরেই সেলিম দালালের এক জেলে এক নৌকা জাটকা নিয়ে ঘাটে পৌছা মাত্র জেলে পালিয়ে যায় আর দালালের কর্মচারীরা ট্রে নিয়ে নৌকা থেকে জাটকা ইলিশগুলো তহবিরে উঠিয়ে ডাকে ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করে। যা বড় হলে ২৫ কোটি টাকার মাছ হত বলে কয়েক ক্রেতা জানান। ওইকানের ১ কেজি জাটকা বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা আর তাতে ১০৫টি মাছ হয়েছে।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের মাঝিরহাট মাছঘাটে গিয়ে চোখে পড়ে একই দৃশ্য। এ ঘাটের জেলে মোঃ জসিম উদ্দিন মাঝি মাঝারী নৌকার এক নৌকা জাটকা ইলিশ পেয়েছেন, তা বিক্রি হয়েছে ৩০০০ টাকা। আড়তদার মোঃ কবির হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, এ মাছ বড় হলে কমপক্ষে ২ কোটি টাকা বিক্রি হতো।

জেলা মৎস্য কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ভোলায় বিশাল জলরাশির জাটকা সংরক্ষণে যে লোকবল দরকার, তা মৎস্য বিভাগের নেই। জেলা-উপজেলা কার্যালয়ে ৬০টি পদ থাকলেও ১৮ জনকে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কার্যক্রম। এখানে কয়েক উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি অভিযান দল গঠন করা দরকার। কর্মকর্তারা আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলায় একটি স্পিডবোট ও একটি দ্রæতগামী ট্রলার দরকার। কিন্তু পুরো জেলায় আছে দুটি স্পিডবোট, তাও তেলের সংকট। জেলে-আড়তদারের নিকট ট্রলার ধার নিয়ে অভিযান চালাতে গেলে শতভাগ সফল হওয়া যায় না। টানা আট মাস অভিযান চালাতে বললেও বরাদ্দ নেই বললেই চলে। গত আড়াই মাস চলে গেলেও কোনো বরাদ্দ আসেনি।

ভোলা মৎস্য বিভাগ জানায়, জানুয়ারি মাসের প্রথম কিস্তিতে সাত উপজেলায় ৪৩টি অভিযান চালিয়ে ৪ জনের জরিমানাসহ ১ লাখ ৬৭ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ও ৪১৩টি নানা রকম অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। মাছগুলো এতিমখানায় বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি শুরু হয়েছে ২৩ জানুয়ারি।

ভোলা জেলা ক্ষুদ্র জেলে ও মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র জেলেদের জাল, মাছ জব্দ করে জাটকা ধরা বন্ধ করা যাবে না। নদীতে নেমে ভয় দেখালে জেলেরা জাটকা শিকারে নামবেন না।

ভোলা জেলা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, লোকবল ও নৌযান সংকটে জাটকা ধরা পড়ছে, জাটকা সংরক্ষণে সবার সহযোগীতা আবশ্যক।

৫৪ বার ভিউ হয়েছে
0Shares