মঙ্গলবার- ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
কুড়িগ্রামে ভুটানের অর্থনৈতিক অঞ্চল,ধরলাকে ঘিরে ভাগ্য বদলের আশার সঞ্চার কুড়িগ্রামসীর

কুড়িগ্রামে ভুটানের অর্থনৈতিক অঞ্চল,ধরলাকে ঘিরে ভাগ্য বদলের আশার সঞ্চার কুড়িগ্রামসীর

সাইয়েদ বাবু,কুড়িগ্রাম জেলা  প্রতিনিধি-২৭-০৩-২৪ দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম,ভাওয়াইয়া গানের ধাম,নদ-নদীময় কুড়িগ্রাম’ জেলা ব্রান্ডিং এর এই তকমা সারাবছর কুড়িগ্রামবাসীকে কাঁদায়। কেননা উত্তরের সীমান্তবর্তী এই জেলাটি নদ-নদী দ্বারা বিষ্টিত হবার কারণে প্রতিবছর ক্ষরা বন্যা আর নদী ভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। এ জেলার নদ-নদীগুলোকে ঘিরে অপার সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে এ নিয়ে জেলার নীতি-নির্ধারকদের তেমন  মাথা ব্যাথার কারণ হয়নি। জেলার নীতি-নির্ধারকরা নিছক প্রাকৃতিক দূযোগ মেনে নিয়ে উপেক্ষা করে গেছে। যার বদৌলতে কুড়িগ্রাম একটা সময় মঙ্গা কবলিত  এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিলো।
বর্তমানে এ জেলায় মঙ্গার তকমা ঘুচলেও শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা না থাকার কারণে সারা বছর গরিব জেলা হিসেবে পরিচিত পেয়ে আসছিলো। এবার এই জেলার বাসিন্দারা তাদের নদ-নদীকে কাজে লাগিয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার বুনছে। জেলা শহরের স্রোতস্বিনী ধরলা নদীকে কেন্দ্র করে বদলাতে চাচ্ছেন নিজেদের ভাগ্যের চাকা।
২০১৫ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ঘোষনা দিয়েছিলেন এ জেলায় তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে জেলাবাসীর মঙ্গা আর গরীবের তকমা চিরতরে দূর করবেন। সেই কথা রাখতেই গতবছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে এক দ্বিপক্ষীয় সভায় ভুটানের রাজা ও রানীর কাছে প্রস্তাব রাখেন সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এই কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সদরের ধরলা নদীর পাড় ঘেঁষে বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। যা জেলার দারিদ্রতা,মঙ্গা আর বেকারত্ব ঘুচাতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এ জেলায় কোন শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা না থাকায় প্রতিবছর নদী ভাঙন আর বন্যায় সহায় সম্বল,ভিটে-মাটি হারিয়ে চরের অধিকাংশ লোকজন ও পড়ুয়া যুবকরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করেন। কেউ রিক্সা চালান,কেউ পোশাক গার্মেন্টসে কেউবা রাজমিস্ত্রির দিনমজুর হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হবার কারণে জেলায় প্রতিনিয়ত বাল্যবিয়ের সংখ্যা বাড়ে অন্যদিকে বাড়ে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। যার কারণে জেলায় ক্রমে বাড়ে দারিদ্রতার হার। জিটুজি ভিত্তিক প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপন হলে এ জেলায় দারিদ্রতার হার কমবে   বলে মনে করছেন জেলার সচেতন মহল। সেই সাথে জেলার মানুষরা এতে যুক্ত হয়ে নিজেদের দারিদ্রতা মোচন করে জেলার উন্নয়নে বড় একটি জায়গা জুড়েও অবদান রাখবে বলে আশার আলো দেখছেন অনেকেই।
ধরলা নদীর পূর্ব প্রান্তের সৈয়দ ফজলুল করিম (রহ.) জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার উত্তর-পূর্ব দিকে এই খাস জমির অবস্থান। এই মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মুফতী আব্দুর রহিম বলেন,ধরলার তীরে এতো বড় বিশাল এই খাস জমিতে ভুটানের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে জেনে আমরা আনন্দিত। এতে করে এই এলাকার অবহেলিত চরাঞ্চলের লোকজনের ভাগ্যের উন্নতি ঘটবে।
এই প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব মহিউদ্দীন খান
বলেন,কুড়িগ্রামের এই অঞ্চলে এই জিনিসটা এতো বেশি দরকার যা জেলা বাসীর জন্য একটা মাইলফলক হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের এখানে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান নাই,মানুষ মফিজ বলে ডাকে এই এলাকাকে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে জেলার ভাগ্য বদলে যাবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সৈয়দ আলী  বলেন,আমি কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, লোহার এ্যংগেল, পাতির ব্যবসা করি। আমাকে ঢাকায় এসমস্ত মালামাল কিনে ব্যবসা করতে হয়। আমার জেলায় নতুন করে কলকারখানা তৈরি হলে আমাকে আর বাইরে গিয়ে ব্যবসা করতে হবে না। নিজের জেলায় ব্যবসা করতে পারবো।
ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সাইদুর রহমান বলেন,কুড়িগ্রাম জেলার বৃহৎ এলাকা চরাঞ্চল।এ অঞ্চলের  পিছিয়ে পড়া মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার  উন্নয়নের জন্য জেলায় কলকারখানা প্রয়োজন। এখান থেকে যেহেতু ভুটান অনেক কাছে সেহেতু ভুটানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত গতিতে বাড়বে। তবে এখানে দীর্ঘদিন ধরে যেসব কৃষক চাষাবাদ করছেন তাদের ন্যায্য অধিকার ও পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করে জমি অধিগ্রহন করলে আরো ভালো হবে।
 সিনিয়র সাংবাদিক, সহকারী অধ্যাপক মোঃ শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন,এ জেলার মানুষ দীর্ঘদিন থেকে সুযোগ-সুবিধা আর অধিকার বঞ্চিত। জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো জেলায় শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, যাতে বাইরে গিয়ে দিনমজুরি করতে না হয়। জেলাবাসীর কাঙ্খিত এই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে যার মাধ্যমে আমাদের বন্দরগুলো আরো সচল হবে,এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সহজে ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসার ঘটবে। শুধু কুড়িগ্রাম নয় গোটা দেশের মানুষ এ জেলা দিয়ে ৩ ঘন্টার সহজ পথ পাড়ি দিয়ে ভুটানে ব্যবসা করতে পারবে। অন্যদিকে বহু আকাঙ্খিত স্থল পথের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি বেগবান হবে।
জেলা প্রশাসন সুত্র জানায়,জেলা সদরের ধরলা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা খাশ জমি গুলো কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সড়কের পাশে ভোগডাঙা ইউনিয়নের মাধবরাম মৌজার অন্তর্ভুক্ত ১৩৩.৯২ একর জায়গাটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে । মূলত ভুরুঙ্গামারীর সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে ভুটানে প্রবেশের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার এতে সহজে যাতায়াত করা যাবে এ পথ দিয়ে। ফলে ভুটানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলে জেলার আর্থ সামাজিক অবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আরও ৮৬ একর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন, এগুলো অধিগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। এছাড়াও জেলার চিলমারী নৌ-বন্দরের কার্যক্রম এর সাথে যুক্ত করে এই বিশেষ অঞ্চলটিকে আরো গতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গত ১০ মার্চ এই বিশেষ অঞ্চলটি সরেজমিনে ঘুরে
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনসিল বলেন,জিটুজি ভিত্তিক প্রস্তাবিত ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ঘুরে দেখলাম। ভুটান সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশের এই অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পর শুধু ভুটান নয় বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে কুড়িগ্রামের মানুষরা বেশি উপকৃত হবে। পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলের মানুষদের ভাগ্য উন্নয়নে অনেক সুযোগ-সুবিধার প্রসার ঘটবে।
বতর্মানে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগুয়েল ওয়াংচুক বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন, তিনি আগামীকাল ২৮শে মার্চ কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে আসছেন।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন,কুড়িগ্রামের সঙ্গে ভারত ও ভুটানের কানেক্টিভিটি বেশ ভালো। কুড়িগ্রামের দুটি স্থলবন্দর ও চিলমারী নৌ-বন্দরের সঙ্গে ভুটানে যোগাযোগ সুবিধা রয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হলে মানুষের সক্ষমতা বাড়বে, আগের চেয়ে এ জেলার অধিকাংশ মানুষ ভালো জীবনযাপন করতে পারবে। সরকার সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে।
৯০ বার ভিউ হয়েছে
0Shares