![জেঁকে বসছে শীত গরীবের সম্বল সিরাজগঞ্জের কম্বল তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে পল্লীর কারিগররা জেঁকে বসছে শীত গরীবের সম্বল সিরাজগঞ্জের কম্বল তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে পল্লীর কারিগররা](https://spnewsbd.com/wp-content/uploads/2023/12/কম্বল-তৈরি.jpg)
জেঁকে বসছে শীত গরীবের সম্বল সিরাজগঞ্জের কম্বল তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে পল্লীর কারিগররা
![](https://spnewsbd.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
এইচএম মোকাদ্দেস,সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় জেঁকে বসছে শীত। এই কনকনে শীত নিবারণে জন্য সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত কাজিপুর উপজেলার শিমুল দাইড় বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলো সরগরম হয়ে উঠেছে গরীবের সম্বল সিরাজগঞ্জের কম্বল তৈরির কাজে। ব্যস্ত সময় পার করছেন কম্বল পল্লী কারিগররা। কম্বল পল্লী হিসেবে খ্যাত কাজিপুর উপজেলার চালিতা ডাঙ্গা ইউনিয়নের শিমুল দাইড় বাজার। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও এই শীতের আগমনে কম্বল তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের ছোট বড় বয়োবৃদ্ধ নারী পুরুষসহ কম্বল পল্লীর সবাই । প্রতিবছর শীতের আগমনে এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে,পাড়া, মহল্লার পরিবার গুলোর মাঁঝে যেন সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে বাড়তি আয়ের সূযোগ সৃষ্টি করে দিতে আসে। কাজিপুরে প্রায় ৩০টি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই কম্বল তৈরি কাজে জড়িত।
এই এলাকায় প্রথমে কম্বল তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। তার পর থেকে প্রতিবছরই এই কম্বল পল্লীতে কম্বল তৈরির কারখানা ও কাজের পরিধি বাড়তে শুরু করেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান কাজিপুর উপজেলার শিমুল দাইড় বাজারেই বড় ছোট মিলে প্রায় ১৫০ জন ব্যবসায়ী রয়েছে। শুরুতে এই অঞ্চলে কম্বল বলতে শূধু জোরা তালি দেয়া বা গার্মেন্টের ঝুঁট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরি হতো। সময়ের ব্যবধানে এর পরিধি বেড়ে একাধিক নাম ও মানের কম্বল তৈরি হচ্ছে এখানে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজিপুর উপজেলার চালিতা ডাঙ্গা ইউনিয়নের শিমুল দাইড় বাজার মেঘাই,সালাভরা, কুনকুনিয়া,মাইজবাড়ি চালিতাডাঙ্গা নয়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঢাকা থেকে গার্মেন্টস এর ঝুঁট কাপড় বা টুকরো কাপড় নিয়ে এসে কেঁচি দিয়ে কেটে সাইজ করে পা মেশিন ও ফ্লাডলক মেশিন দিয়ে সেলাই করে কম্বল তৈরি করছেন।
এতে এ অঞ্চলে শীত মৌসুমী শুরু হলেই কম্বল তৈরির কাজে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শিমুল দাইড় গ্রামের আলতাফ হোসেন বলেন,গার্মেন্টস থেকে ঝুট ও টুকরো কাপড় সংগ্রহ করে এনে বিভিন্ন ছোট বড় সাইজ অনুযায়ী কেটে ফ্লাডলক মেশিন দিয়ে সেলাই করে ছোট বাচ্চাদের হুডি, পায়জামা,গেঞ্জিসহ বিভিন্ন রকমের কম্বল তৈরি করি।এরপরে তৈরি পোশাক গুলো গুছিয়ে সাজিয়ে রাখি। এখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে খুচরা বিক্রেতা এসে পাইকারি দামে পোশাক ও কম্বল কিনে ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যান। দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি থাকায় বর্তমানে আমরা সঠিক দাম পাচ্ছি না। কোন রকমভাবে এগুলো বিক্রি করে চালান তুলতে হচ্ছ।শিমুল দাইড় বাজারের আরেক ব্যবসায়ী সোহেল ট্রেডার্স এর মালিক শরীফুল ইসলাম সোহেল জানান, সেই ১৯৯৪ সালের জোড়াতালির কম্বল ছাড়াও এ অঞ্চলে বিস্বাস,চায়না এ্যামব্রাশ, ৩ ডি,৫ ডি, ৬ডি নামের উন্নত মানের কম্বল তৈরি হচ্ছে। জোড়াতালি বা ঝুট থেকে তৈরি কম্বল ১০০ শত টাকা থেকে ৪শ টাকা, বাংলা ১৩০ থেকে হাজার টাকা,এবং বিস্বাস,চায়না,এ্যামব্রাশ, ৩ ডি,৫ ডি ৬ডি নামের কম্বল গুলো মান ভেদে ৪শ থেকে ৭/৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পা,মেশিনের কারিগররা প্রতি পিস কম্বল তৈরিতে মজুরী বাবদ ৫০ থেকে ৭০ টাকা করে পেয়ে থাকেন। আর ফ্লাডলক মেশিনে একেকজন শ্রমিক ৮শ থেকে ৯শ পিস কম্বল তৈরি করে থাকেন ।
এক্ষেত্রে প্রতি পিস কম্বলের ওজনের পরিমাপে ১ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। মেয়েদের কম্বল তৈরিতে মজুরী কম হলেও গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি শীত মৌসুমে পরিবারের মেয়ে ছেলে সকলেই মিলে এই কম্বল সেলাইয়ে কাজে ব্যস্ত থাকায় একক চাপ থাকে না ফলে সহজেই পরিবারের সকলে মিলে শীত মৌসুমে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও সংসারে বাড়তি আয় করে থাকেন। সরজমিনে গিয়ে কথা হয় কম্বল তৈরির কারিগর সালাভরা গ্রামের সালমা বেগমের সাথে। সালমা বেগমের ১ ছেলে ১ মেয়ে। মেয়ে ৫ম শ্রেনীতে পড়ে, ছেলে ৩য় শ্রেনীতে। তিনি জানান আমাদের কাজিপুর নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকা হওয়ায় পরিবারের পুরুষদের হাতে তেমন কাজ কর্ম থাকে না। ফলে বছর জুড়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। তবে শীত আসলে আমাদের হাতে কম্বল তৈরির বাড়তি কাজ সৃষ্টি হওয়ায় সংসারের অভাব দুর করতে সক্ষম হয়েছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার ফাঁকে মায়ের সেলাইয়ের কাজে টুকরো কাপড় গুছিয়ে মাকে কম্বল তৈরিতে সহযোগিতা করে থাকে।
আব্দুল মজিদ শিমুল দাইড় বাজারে ফ্লাডলক মেশিনে কাজ করেন তিনি সেখানে তার প্রতিদিন ৮/৯শ টাকার মত আয় রোজগার হয়। আর এভাবেই সংসারের খরচ বাদে ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া করাতে আব্দুল মজিদকে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। আত্ম সামাজিক উন্নয়নের এই গল্প কাজিপুরের সালাভরা আব্দুল মজিদের পরিবারের শুধু একার নয়, এই গল্প কম্বল পল্লীর শীত মৌসুমের দুই সহস্রাধিক পরিবারের। এটাকে কেন্দ্র করে শিমুল দাইড় বাজারে গড়ে উঠেছে প্রায় তিন শতাধিক যন্ত্র চালিত ফ্লাডলক পাওয়ার মেশিন চালিত কম্বল তৈরির কারখানা। এছাড়া ওই এলাকায় প্রায় ২০ হাজারের মত ফ্লাডলক মেশিনে শ্রমিকরা কর্মরত রয়েছেন। কাজিপুরের শিমুলদাইড় বাজার সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম সোহেল জানান, ১৯৯৪ সালে আমাদের এখানে প্রথম গার্মেন্টসের ঝুঁটকাপড় দিয়ে কম্বল তৈরি শুরু করে স্থানীয়ভাবে বেচাকিনি শুরু হয়। এখনে কম্বলের পাশাপাশি ছোট ছেলেমেদের পোশাকসহ প্রায় ৫২টি আইটেম এই এলাকায় তৈরি হচ্ছে। এখানকার তৈরি কম্বলসহ অন্যান্য তৈরি সামগ্রী স্থানীয় চাহিদার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের শীত প্রবল এলাকা সমুহ রংপুর,দিনাজপুর ,পঞ্চগড় ,ঠাকুরগাঁসহ উত্তাঞ্চলের প্রায় সব জেলাসহ দক্ষিন অঞ্চলের বাগের হাট,কুষ্টিয়া,খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ থেকেও ব্যাপারী মহাজনরা এসে এই কম্বল ক্রয় করে নিয়ে যান। তিনি আরও বলেন, শীতের এই মৌসুমে শিমুলদাইড় বাজার হতে ২৫/৩০ লক্ষ পিস কম্বল দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। শিমুলদাইড় বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতান জানান এক সময় এই ব্যবসাটি স্থানীয় পর্যায়ে হলেও সময়ের ব্যবধানে এর পরিধি বেড়ে সারা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। তিনি আরও জানান আমাদের স্থানীয় বেপারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন রকমের সহযোগীতা করা হয়। আশা করছি আগামীতে এই কম্বল ব্যবসাটি আরো প্রসার ঘটবে। কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুখময় সরকার জানান, এখানকার কম্বল সারা বাংলাদেশে যাচ্ছে। মানে ও গুনে এবং দামে কম হওয়ায় সারা দেশে এর চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। এই কম্বল তৈরির ব্যবসায় অনেক বেকারত্বের অবসান হয়েছে। এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন রকমের সহযোগীতা করা হবে। এতে করে আগামীতে এই কম্বল ব্যবসাটির আরো প্রসার ঘটবে।
২৬ বার ভিউ হয়েছে