শনিবার- ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১৫ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও ১০০ শয্যারও জনবল নেই, চরম সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও ১০০ শয্যারও জনবল নেই, চরম সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

মোঃ বুলবুল  ইসলাম ,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ চিকিৎসক, কর্মচারী আর চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটে বিঘ্নিত হচ্ছে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। ছয় বছর আগে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হলেও  ১০০ শয্যার জনবল কাঠামো নিয়ে চিকিৎসা কর্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে সেই জনবলেরও বেশিরভাগ পদ শূন্য। ফলে চিকিৎসাকেন্দ্রটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। রয়েছে পরিচ্ছন্নতা ও ওষুধ সংকট।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, জনবল ও ওষুধের চাহিদা জানিয়ে বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ৫০ শয্যার কুড়িগ্রাম হাসপাতালটি পরবর্তী সময়ে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এটিকে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের অনুমোদন দেয়। তবে এখনও হাসপাতালটি ১০০ শয্যার মঞ্জুরিকৃত জনবল নিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে চলছে। সেই জনবলেরও বেশিরভাগ পদ শূন্য।
চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সংকটে বিঘ্নিত স্বাস্থ্যসেবা:
চলতি সপ্তাহে সরেজমিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের সত্যতা মেলে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা বলছেন, সারাদিনে মাত্র একবার চিকিৎসকের দেখা মেলে। দুপুরের পর হাসপাতালে কোনও রোগী ভর্তি হলে জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ছাড়া পরের দিন সকালের আগে ওয়ার্ডে আর কোনও চিকিৎসকের দেখা মেলে না। কোনও স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিলে তার রিপোর্ট দেখাতে হয় পরের দিন। ফলে মূল চিকিৎসা পেতে অনেক রোগীকে ভর্তির পর ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। ওয়ার্ডের শয্যা সংকট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও শৌচাগার নিয়েও ক্ষোভ জানান রোগীরা।
হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী সদরের মন্ডল পাড়ার বাসিন্দা রাশেদ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকালে প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির সময় জরুরী বিভাগের চিকিৎসক দেখেছেন। এরপর রাত পেরিয়ে সকাল গড়ালেও ওয়ার্ডে কোনও ডাক্তারের দেখা মেলেনি।’
পরিচ্ছন্নতা প্রশ্নে এই রোগী বলেন,‘ হাসপাতালের টয়লেটে যাওয়া যায় না। রুমের ভেতরও ময়লা।’
একই ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ভর্তি হই। কিন্তু পরের দিন শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ওয়ার্ডে কোনও ডাক্তারের দেখা মেলেনি। চিকিৎসা বলতে শুধু স্যালাইন দিয়েছে। তাও সব বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। শুধু সান্তনা যে হাসপাতালে ভর্তি আছি।’
গত সপ্তাহে মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেওয়া রোগী রিপন মিয়া বলেন, ‘ সন্ধ্যায় যখন ভর্তি হই তখন দেখি পুরো রুমে ময়লা। বেডের নিচেও ময়লা। বলার পরও কেউ পরিষ্কার করে নাই। শেষে নিজেরা পরিষ্কার করে বেডে উঠছি। দিনে একবারের বেশি ডাক্তারের দেখা পাওয়া যায় না। এই হইলো অবস্থা।’
এই ওয়ার্ডের বেশ কিছু রুমে গিয়ে দেখা গেছে রোগীদের বেডের পাশে বেড লকার নেই। রোগীরা ওষুধ, পোশাক ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেডের ওপর রেখে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৩ ও ৪ নং রুমে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কোনও বেড নেই। রোগীরা মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রুম গুলো অপরিচ্ছন্ন। অথচ ভবনটি নতুন।
চিকিৎসক ঘটতি ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একই অভিযোগ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের রোগী ও তাদের স্বজনদের। ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা এবং টয়লেটের অবস্থা নাজেহাল বলে জানান তারা। ওই ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী আব্দুর রহমান বলেন, ‘ বিকালে ভর্তির পর সারারাত শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে পারি নাই। কিন্তু রাতে নার্স ছাড়া কোনও ডাক্তারের দেখা মেলেনি। পরের দিন সকালে ডাক্তার দেখে ওষুধ দিয়েছেন।’
এই ওয়ার্ডের আরেক রোগীর স্ত্রী শিরিন খন্দকার বলেন, ‘টয়লেট অপরিচ্ছন্ন। লাইট (বাল্ব) নাই। দরজার লক নষ্ট। কীভাবে ব্যবহার করবো বলেন।’
২৫০ শয্যার হাসপাতালে ১০০ শয্যার জনবলও নেই:
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে বর্তমানে চিকিৎসক প্রয়োজন ৫৮ জন। কিন্তু এই জনবলের অনুমোদন মেলেনি। ১০০ শয্যার মঞ্জুরিকৃত ৪২ পদের বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৩ জন। একজন এনেসথেসিস্ট ছাড়া সিনিয়র কনসালটেন্টের ১০ টি পদের ৯টি পদই শূন্য। জুনিয়র কনসালটেন্টের ১২ টি পদের ৫ টি শূন্য। নেই চক্ষু রোগের চিকিৎসক ও প্যাথলজিস্ট।
১১ জন স্টাফ নার্সের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৫ জন। ২য় শ্রেণির অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১৫ টি, ৩য় শ্রেণির ৫২ টি পদের বিপরীতে ৩৭ টি এবং ৪র্থ শ্রেণির ২৮ টি পদের বিপরীতে ১৩টি পদ শূন্য । মোট ২৯২ টি পদের বিপরীতে ৮৫ টি পদ শূন্য রয়েছে। তবে এসব জনবল ১০০ শয্যার মঞ্জুরি মোতবেক। গত ছয় বছরেও ২৫০ শয্যার জনবল কাঠামোর অনুমোদন মেলেনি। ফলে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা.মো.শহিদুল্লাহ বলেন, ‘জনবল সংকট নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা বিষয়টি লিখিত ভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।  এখনও কোনও সমাধান পাওয়া যায়নি।’ শয্যা সংকট ও অপরিচ্ছন্নতা সহ অন্য সমস্যার বিষয়ে কথা বলার সুযোগ দেননি এই চিকিৎসা কর্মকর্তা।
২৮ বার ভিউ হয়েছে
0Shares