সোমবার- ১লা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১৭ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
রেল প্রকল্পগুলো ভারতীয় ঋণে গতিহীনতায় ভুগছে

রেল প্রকল্পগুলো ভারতীয় ঋণে গতিহীনতায় ভুগছে

ভারতীয় ঋণে বাংলাদেশের রেল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আশানুরূপ গতি নেই। ঋণ ছাড়ে গড়িমসি, নানা শর্ত, প্রতিটি ধাপ অনুমোদনে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকে জটিলতায় প্রকল্পগুলোর কাজ সামনে এগোচ্ছে না। মূলত ঋণের শর্তানুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ এবং নির্মাণসামগ্রী কেনার বাধ্যবাধকতায় প্রকল্পগুলোর কাজের গতিতে ছেদ পড়ছে। ওসব বিষয়ে ভারতকে অনুরোধ আর তাগাদা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভারতের ঋণে খুলনা-মোংলা ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প এক যুগেও শেষ হয়নি। বিগত ২০১০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প অনুমোদনের সময় নির্মাণ কাজ ৩ বছরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ১২ বছরেও কাজ শেষ হয়নি। বরং আগামী ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অনুমোদনের সময় ৫ বছরে খুলনা-দর্শনা এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ নির্মাণ পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ওই কাজ প্রায় ৫ বছরেও শুরু করা যায়নি। সম্প্রতি প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজের দেখভালে ৪ বছরের চুক্তিতে পরামর্শক নিয়োগ চুক্তি হয়েছে। ফলে প্রকল্প দুটির মেয়াদ নিশ্চিতভাবেই ৪ বছর বাড়তে যাচ্ছে। পৌনে ৫ বছরে রেলের ওই দুই প্রকল্পে ভারত এক টাকাও ঋণ দেয়নি। শুধু তাই নয়, ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) এবং অনুদানে চলমান রেলের সাত প্রকল্পেই একই অবস্থা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় এলওসিতে ১৬ হাজার ৮১৬ কোটি টাকায় রেলে ৬টি প্রকল্প চলছে। ওসব প্রকল্পে ১১ হাজার ৬১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা ভারত ঋণ দেবে। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ। এলওসি প্রকল্পের ধীরগতিতে প্রকল্পগুলো খুবই ধীরগতিতে চলছে। বিষয়টি সমাধানে রেলমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়েও তাগিদ দিয়েছে। পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকেও ঋণের টাকা ছাড়ে জটিলতা নিরসনে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটছে না।
সূত্র আরো জানায়, প্রথম এলওসির প্রকল্প খুলনা-মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ৯৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা না করেই প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। ওই সময়ে ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী দুই দফায় বেড়ে তা ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। ঋণের শর্তানুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদার প্রকল্পের কাজ করছে। কিন্তু ভারতীয় ঠিকাদারের সরবরাহ করা স্লিপার নিম্নমানের ছিল। সেজন্য তা বাতিল করা হয়। তাছাড়া অনভিজ্ঞ সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ এবং জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজে দেরি হচ্ছে। তাছাড়া সিগন্যালিং ব্যবস্থার ঠিকাদার নিয়োগেও জটিলতা হয়েছে। দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি ব্যয় প্রস্তাব করে। এমন পরিস্থিতিতে জটিলতা কাটাতে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে সিগন্যালিংয়ের কাজ করছে। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগ হলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। আর বিগত ২০১১ সালের জুলাইয়ে অনুমোদিত কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পে খরচ বেড়েছে ৪৭৭ শতাংশ। গত জুলাই পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) প্রকল্পটিতে ৮৭ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তার মধ্যে ভারতীয় ঋণ ৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। তবে ছাড় হওয়া ৬৮ কোটি ৯২ লাখ টাকার মধ্যে ভারতীয় ঋণের পরিমাণ মাত্র ১৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। তাছাড়া ৫২ কিলোমিটার কুলাউড়া-শাহবাজপুর পুনর্বাসন কাজ করছে ভারতীয় ঠিকাদার। প্রকল্প অনুমোদনের ৬ বছর পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে চুক্তি হয়। তাতে প্রকল্প খরচ ১৪২ কোটি থেকে বেড়ে ৬৭৮ কোটি টাকা হয়েছে। বারবার তাগিদ দিয়েও ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাতে পারেনি রেল। বরং ঠিকাদার কখনও করোনা, কখনও জমি ও বিদ্যুতের খুঁটি বা গাছের অজুহাত দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ে ভারতীয় ঠিকাদারকে বাদ দিতে চুক্তি বাতিল করতে চায়। কিন্তু এলওসির ঋণে ভারতীয় ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানোর বাধ্যবাধকতা থাকায় তা করা যাচ্ছে না। আর ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন প্রকল্পে ১০ বছরে কাজ হয়েছে ৬৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগামী বছরের জুনে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে ২০২৪ সালের জুনের আগে ঢাকা প্রকল্পটি কিছু অংশের কাজ করা সম্ভব নয়। আর ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকার ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পে ভারত ঋণ দেবে ৯০২ কোটি টাকা। এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ২৩৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তার মধ্যে ভারতীয় ঋণ ২১৯ কোটি টাকা। তবে ছাড় হওয়া মাত্র ৫ কোটি ১২ লাখ টাকার মধ্যে ভারতীয় ঋণের কোনো টাকা নেই। এলওসির ঋণে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্প অনুমোদনের পর ৪ বছরে পৌনে ৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এ বছরের এডিপি প্রকল্পটির জন্য ২১৮ কোটি বরাদ্দ রয়েছে। তার মধ্যে ভারতের ঋণ মাত্র ১৮ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৯৮ কোটি টাকায় সমীক্ষা করতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রাইটস ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং আরভি ইন্ডিয়াকে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র হয়নি। অথচ ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ওই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। নিশ্চিতভাবেই সময় ও খরচ বাড়তে যাচ্ছে। বিগত ২০১০ সালের প্রাক-সমীক্ষায় যে পথ ধরে (অ্যালাইনমেন্ট) বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেখানে বহুতল ভবন, বাজার, সড়ক তৈরি হওয়ায় অ্যালাইনমেন্ট বদলের সুপারিশ করেছে পরামর্শক। তবে তাতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের (এমপি) আপত্তি রয়েছে। আর ২০১৮ সালে অনুমোদিত ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় খুলনা-দর্শনা ১২৬ কিলোমিটার ডাবল লাইন এবং ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায় পার্বতীপুর-কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণকাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু গত ২৫ আগস্ট পরামর্শক নিয়োগ হয়েছে। ওই দুই প্রকল্পে এ বছরে এক টাকাও ভারতীয় ঋণ ছাড় হয়নি। পৌনে ৫ বছরে এক টাকাও দেয়নি ভারত। তাছাড়া ৪৭৮ কোটি টাকায় ১০ দশমিক ১ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণে ৪২১ কোটি টাকা অনুদান দেবে ভারত। কিন্তু জুলাই পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র সাড়ে ৬০ শতাংশ। সেক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, করোনার অজুহাত দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় ঠিকাদার বাড়তি টাকা চাইছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর গণমাধ্যমকে জানিয়েন, প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে দুই দেশ যৌথভাবে তদারকি করছে। যেসব জটিলতা রয়েছে, সেগুলো কাটাতে কাজ চলছে।

৮২ বার ভিউ হয়েছে
0Shares