রবিবার, ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই ৪৮ ঘন্টার কর্মসূচী চলছে

জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই ৪৮ ঘন্টার কর্মসূচী চলছে

Views
লালমনিরহাট প্রতিনিধি। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ -স্লোগানে কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কর্মসূচি সফল করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে আয়োজক কমিটি।

জানা গেছে, ভারতের সিকিমে জন্ম নেওয়া তিস্তা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক এ তিস্তা নদী। যা নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে এ নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।

উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত সরকার তিস্তা নদীর পানি একতরফা ব্যবহার করছে। এতে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে বর্ষা শেষ হতেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে জীববৈচিত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আবার বর্ষাকালে ভারত অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে নদীভাঙন ও বন্যার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ অংশের রংপুর বিভাগ। মূলত, পানির প্রয়োজনে পানি শূন্য আবার যখন প্রয়োজন নেই তখন পানি দিয়েই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ডুবিয়ে রাখে ভারত। এভাবে তিস্তাকে নিজেদের স্বার্থে এক তরফা শাসন করছে ভারত।

এ কারণে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা হচ্ছে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ে। পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি আদায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন সময় নানান কর্মসূচি পালন করেছে। তিস্তা নদী আর এর পানি ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বহু আন্দোলন সংগ্রাম হলেও সুফল পায়নি তিস্তাপাড়ের মানুষ। তিস্তাকে পুঁজি করে সরকারি ও বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম করে নিজেরা ক্ষমতায় সফল হলেও সুফল মেলেনি নদীপাড়ের মানুষের। ভাগ্যেরও উন্নয়ন ঘটেনি তিস্তাপাড়ের মানুষের।অপর দিকে জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় তিস্তা নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। ফলে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢেউয়ে নদীর দু’কুল বন্যায় প্লাবিত হয়। বন্যায় ভেসে যায় ফসল আর তীব্র ভাঙনে বিলীন হয় বসতভিটা আবাদি জমিসহ স্থাপনা। লোকালয়ে প্রবেশ করে প্রতি বন্যা মৌসুমে পরিবর্তন হচ্ছে নদীর গতিপথ। প্রতিবছর তিস্তা নদীর ভাঙনে হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ছে। বন্যা শেষে ধু-ধু বালু চরে পরিণত হয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে রংপুর অঞ্চলের ৫টি জেলার হাজার হাজার হেক্টর জমি।

তিস্তাপাড়ের এ দুর্ভোগ দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবছর পিছিয়ে পড়ছে উত্তরাঞ্চল। রংপুর বিভাগের উন্নয়নের প্রধান বাধা তিস্তা নদী। এ নদীকে শাসন করতে পারলেই তা আর্শিবাদে পরিণত হবে। এ অঞ্চলে প্রতিবছর নদী ভাঙন রোধে বাঁধ, বন্যার্ত আর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে শত শত কোটি রাষ্ট্রীয় টাকা অপচয় হলেও কার্যত কোনো ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি তিস্তা পাড়ের মানুষের।

তিস্তাপাড়ের কৃষক উদ্দিন বলেন, তিস্তার ভাঙনে ১২/১৪ বার বসত ভিটা সরিয়ে নিয়েছি। শুষ্ক মৌসুমে বালু জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে যা চাষাবাদ করে পাই সেটুকু দিয়ে চলে পুরো বছর। শুষ্ক মৌসুমে বাড়ি তৈরি করি। বর্ষার বন্যায় তা ভেসে বা ভেঙে যায় নদীতে। যা আয় করি তা সবই তিস্তায় বিলীন হচ্ছে। তাই চাই স্থায়ী বাঁধ। যাতে ফসল নষ্ট না হয় বা বসতভিটা ভেসে না যায়।

তিস্তাপাড়ের জেলে অবিনাশ চন্দ্র জানান, বাপ-দাদারা তিস্তা নদীতে সারা বছর মাছ ধরত। তিস্তা নদীর শুঁটকি সারাদেশে চলে যেত। এখন বর্ষার ২/৩ মাস মাছ ধরতে পারলেও বাকি সময় পরিবারের খাবার যোগানো কষ্ট হয়ে পড়ে। পানি না থাকায় অনেক জেলে তাদের পেশার পরিবর্তন করেছেন। আগের মতো নেই তিস্তা নদীতে মাঝি মাল্লাদের ডাক হাক। তিনিও দাবি করেন দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।

মাঝি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ৪ মাস তিস্তায় নৌকা চললেও বাকি সময় পায়ে হেঁটে যায় মানুষ। খরস্রোতা তিস্তা বর্ষা শেষেই যৌবন হারিয়ে ফেলে। ফলে নৌকা বা খেয়াঘাটে আর তেমন যাত্রী মেলে না। আগে সারাবছর নৌকা চলত নদীর বুকে। এখন বর্ষার শেষে নদীর বুকে ধু-ধু বালু চর।

তিস্তাপাড়ের আদিতমারী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) আবু তাহের বলেন, তিস্তা নদী শাসন করতে পারলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি বিপ্লব ঘটবে, শিল্প বিপ্লব ঘটনাও সম্ভব। বন্যায় ভাঙনরোধে যে অর্থ প্রতিবছর তিস্তায় ভেসে যায়, তা আর যাবে না স্থায়ী বাঁধ হলে। একই সাথে চাষাবাদের আওতায় আসবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। সব মিলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পিছিয়ে পড়া তিস্তাপাড়ের মানুষই হবে প্রথম সাঁরির জাতীয় অর্থনৈতিক যোদ্ধা।

কর্মসূচি সফল করত নদী পাড়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ একাধিক স্থানে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। থাকবে তিস্তা পাড়ের মানুষের সুখ দুঃখের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, ভাওয়াইয়া গানের আসর, দিনভর থাকবে ঘুড়ি উৎসবসহ নানান গ্রামীণ খেলাধুলা। স্থানীয়দের নিজেদের চাল ডালের সহায়তায় পরিবেশিত হবে খিচুরিসহ প্রয়োজনীয় খাবার। এভাবে টানা ৪৮ ঘণ্টা তিস্তা নদীর তীরেই অবস্থান করবেন রংপুরের ৫টি জেলার কয়েক লাখ মানুষ। দীর্ঘ দিন ধরে চলছে প্রচারাভিযান। ব্যাপক লোক সমাগমের প্রত্যাশা আয়োজক কমিটির।

তিস্তা রক্ষা আন্দোলনের প্রধান ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলু বলেন, আমাদের এ আন্দোলন কোনো দল বা মতের নয়। এটি গোটা রংপুর অঞ্চলের মানুষের গণদাবি। যার মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। আমরা চাই, তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে অবহেলিত এ অঞ্চলে স্যাটেলাইট ভিলেজ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন কেন্দ্র, গড়ে উঠুক কৃষি ও শিল্প বিপ্লব। রংপুর অংঞ্চলের মানুষ দাবি আদায়ে আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। যৌক্তিক দাবি পূরন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ আন্দোলন চলতে থাকবে। প্রথম দফায় যে ৪৮ ঘণ্টা টানা অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে তা সফল করতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

Share This

COMMENTS