মঙ্গলবার- ১৮ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ডাঃ শামসাদ আলীর জীবনী তুলে ধরলেন – খোলাহাটী কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাস

মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ডাঃ শামসাদ আলীর জীবনী তুলে ধরলেন – খোলাহাটী কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাস

একরামুল হক বেলাল,পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : শহিদ ডাঃ শামসাদ আলী একজন চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক ছিলেন।  ডাঃ শামসাদ আলী ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ বিহারের এলাহাবাদে তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতা মরহুম আবুল হোসেন ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। তাই তিনি ক্যাপ্টেন ডাক্তার নামেই পরিচিত। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানার মুজাফ্ফরনগরে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। তাঁর মাতা আনোয়ারী বেগম  অবাঙালি নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর বংশধর হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের পর বাঙালি জাতীয়তা বোধ তাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে এবং শিক্ষিত হওয়ার কারণেই বাঙালির রাজনৈতিক অধিকারে তিনি ছিলেন কট্টর সমর্থক।

ডাঃ শামসাদ আলী পার্বতীপুরে প্রাথমিক ও অন্যান্য শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ত্যাগ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ১৯৬৩ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।

শামসাদ আলী ১৯৬৩ সালে সরকারের মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন এবং কুমিল্লা থানা হেলথ কমপ্লেক্সে তাঁকে পদায়ন করা হয়। দুই বছর সেখানে চাকরির পর ডাঃ শামসাদ আলী সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পার্বতীপুরে ব্যক্তিগত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হন। পার্বতীপুরে নতুন বাজারে তিনি তাঁর নিজস্ব ফার্মেসি ও চেম্বার প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বহু অবাঙালিকে পার্বতীপুরে পুনর্বাসন করা হয়। পার্বতীপুর শহরে সংখ্যায় অবাঙালি  ছিল বেশি এবং প্রভাবশালী। সেখানে  অবাঙালি (বিহারি) বিরোধ লেগেই ছিল। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন বিশেষত উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানকালে এই বিরোধ প্রকট হয়ে উঠে। আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে ডাঃ শামসাদ আলীর অগ্রণী ভূমিকার জন্য তিনি এলাকার অবাঙালিদের আক্রোশের শিকার হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে –  পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের (বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী) হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে ডাঃ শামসাদ আলী তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের বাড়িতে অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তাদের বাড়ির চারপাশে ছিল অবাঙালিদের বসতি।

১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল রাত প্রায়  ১১ টায় আট/নয় জন পাকিস্তানি সেনার একটি দল কয়েকজন অবাঙালি দালালসহ ডাঃ শামসাদ আলীর বাড়ির দরজায় করাঘাত করে। ডাঃ শামসাদ আলীর এক ভাই দরজা খুলে দিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তল্লাশির অজুহাতে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ডাঃ শামসাদ আলীর পিতা-মাতাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের রাইফেলের মুখে তাড়া করে বাইরে এনে এক সারিতে দাঁড় করানো হয়। ডাঃ শামসাদ আলী তখন ছিলেন বাড়ির দোতলায়। তিনি অবস্থা বুঝে দ্রুত ছাদে গিয়ে কার্নিশের আড়ালে লুকান। সৈন্যরা তাঁকে খুঁজে বের করে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। তারপর অন্যদের বাড়িতে রেখে একমাত্র ডাঃ শামসাদ আলীকে তারা ধরে নিয়ে যায় রেলস্টেশন হতে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে হোম  সিগন্যাল এর কাছে। সেখানে ডাঃ শামসাদ আলীকে একজন অবাঙালি থ্রী নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তার শরীরের বাহু থেকে হাত বিচ্ছিন্ন করে কয়লার ইঞ্জিনের জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে।

প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী ডাঃ শামসাদ আলী ছিলেন সংস্কৃতি চর্চায় অনুরাগী। ক্রীড়াবিদ ও গায়ক ডাঃ শামসাদ আলী পার্বতীপুরে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁরই উদ্যোগে পার্বতীপুরে ‘প্রগতি সংঘ’ নামে একটি সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সংগঠন গড়ে উঠে।

জাতির জন্য তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পার্বতীপুরের নতুন বাজারে একটি রাস্তার নামকরণ হয় শহীদ ডাঃ শামসাদ আলী রোড।

বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ জাতির জন্য তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহিদ ডাঃ শামসাদ আলীর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

২২১ বার ভিউ হয়েছে
0Shares