শনিবার- ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১৫ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
কুড়িগ্রামে ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী ও উদ্যোক্তা আই ফার্মারের কাছে জিম্মি

কুড়িগ্রামে ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী ও উদ্যোক্তা আই ফার্মারের কাছে জিম্মি

সাইদ বাবু,কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি :: কুড়িগ্রামের হাজারো ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী ও উদ্যোক্তা আই ফার্মার লিমিটেড এর কাছে জিম্মি ও প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বর্গা ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব খামারীদের স্বাবলম্বী করার আশা দেখিয়ে বর্গা পদ্ধতিতে অর্থ সহায়তা দিলেও এখন ২০% বাধ্যতামূলক সুদ দাবি করছে প্রতিষ্ঠানটি। সুদ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এসব খামারী, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের বির“দ্ধে মামলা করেছে ওই প্রতিষ্ঠান। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় অনেকেই হয়েছেন বাড়ি ছাড়া। তাদের দু’চোখে এখন শুধুই অন্ধকার ভবিষ্যত। আই ফার্মারের প্রতারণা থেকে মুক্তি চেয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক, দুর্নীতি দমন কমিশন সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছে এসব ভূক্তভোগী পরিবার। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আজ ২২ মার্চ আই ফার্মার কর্তৃপক্ষের কাছে বৈধ কাগজপত্র চেয়েছে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশিদুল হাসান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ১৯টি জেলায় কাজ করছে আই ফার্মার লিমিটেড। কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলার প্রায় ১ হাজার ২’শ ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী এবং উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছে আই ফার্মার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় ঢাকার গুলশান-২ এ। কুড়িগ্রামের প্রান্তিক এসব ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী ও উদ্যোক্তাদের মাঝে ইতোমধ্যে কঠিন শর্তে প্রায় ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এনজিও ব্যুরোর বৈধ কাগজপত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রাণি সম্পদ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কতৃক লিখিত কিংবা মৌখিক অনুমতি না থাকলেও বর্গা পদ্ধতির আড়ালে দেদারছে ঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সুদ ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি।

দেশের সর্বোচ্চ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে কুড়িগ্রামের মানুষ। এখানকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস্য কৃষি। ঋণ গ্রহণে দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে কঠিন শর্ত থাকায় এখানকার ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারীরা এনজিও এবং ব্যক্তি পর্যায়ে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ, খামার এবং উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এরই সুযোগ নিয়ে জমির মুল দলিল, ফাকা স্ট্যাম্প এবং ব্যাংকের ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নিয়ে বর্গা পদ্ধতিতে কুড়িগ্রামের প্রায় ১ হাজার ২’শ ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারীদের মধ্যে কাউকে গর“, বয়লার, সোনালী ও লেয়ার মুরগি, হাঁস, মাছ চাষ, আলুর আবাদ, পটল, বেগুন ও ধান চাষের উপর লাভ-লোকসানের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বর্গার কথা বলে অর্থ প্রদান করে আই ফার্মার লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ৪শতাধিক ভূক্তভোগী সেই অর্থ পরিশোধ করে। কিন্তু চরাঞ্চলের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী এবং উদ্যোক্তারা সম্প্রতি মহামারী করোনা, অতি বৃষ্টি, নদী ভাঙন এবং বন্যায় সব হারিয়ে পথে বসে। লাভ তো দূরের কথা পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা এসব খামারী। এমন পরিস্থিতিতে আই ফার্মার লিমিটেড তাদের বেঁধে দেয়া শর্ত ভঙ্গের অজুহাতে এসব খামারিদের বির“দ্ধে আইনি নোটিশ, মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানার আশ্রয় নিয়েছে। এতে অনেকেই এখন আই ফার্মারের ফাঁদে পড়ে ফেরারি আসামী হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। এসব পরিবারের সদস্যরা এখন অমানবিক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের গর“র খামারী মন্তাজ আলী আই ফার্মারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের একটি গর“ বর্গা ভিত্তিতে ঋণ নেয়। কিন্ত লাম্পি স্কিন রোগে গর“টি মারা যায়। পরে ২০% সুদ সহ মুলধন দাবি করে আই ফার্মার। এতে অপারগতা প্রকাশ করায় তার বির“দ্ধে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কারণে তিনি বর্তমানে পলাতক।

কুড়িগ্রামের ত্রিমোহনী হরিশ্বর এলাকার খামারী উদ্যোক্তা মেহেদি হাসান মিলন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দ্বারস্থ হয় আই ফার্মারের কাছে। ৬ লাখ টাকায় ৭টি গর“ কিনে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। লাম্পি স্কিন ও মহামারী করোনায় পানির দরে সব গর“ বিক্রি করেন। আই ফার্মার লাভ লোকসানের দায়ভার নিলেও তা করেনি। ২০% সুদ দিয়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসানে পড়ে এখন নিঃস্ব মেহেদি হাসান মিলন।

সদর উপজেলার নয়ারহাট এলাকার আরেক পোল্ট্রি খামারী এনামুল হক। আই ফার্মার বর্গার কথা বলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বয়লার মুরগির বাচ্চা কিনে দেয় তাকে। রানী ক্ষেত এবং গাম্বুরা রোগে সব মুরগি মারা যায়। এতে এনামুল মুলধন হারিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার লোকসানের মুখে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে আই ফার্মার ২০% সুদ সহ মুলধন দাবি করে। ক্ষুদ্র খামারী এনামুল তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার বির“দ্ধেও করা হয় মামলা। বর্তমানে তিনিও পলাতক রয়েছেন।

কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার ডেইরি ও পোল্ট্রি খামারী মোছাঃ সামছুন নাহার আই ফার্মারের কাছে বর্গা শর্তে ৬ লাখ টাকা ঋণ নেয়। কলেরা, গাম্বুরা এবং রাণী ক্ষেত রোগে ডিম পাড়া সব মুরগি মারা যায়। এতে বিপাকে পড়েন তিনি। কিন্ত আই ফার্মারের চাপে কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।

এছাড়া আই ফার্মারের কাছে জিম্মি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের গর“র খামারী মন্তাজ আলী, ফার“ক মন্ডল, আশরাফুল আলম, মনছুর আলী, আশরাফ, মমেনা বেগম, হলোখানা ইউনিয়নের মাছের খামারী সাদিকুল ইসলাম সেলিম মিয়া, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের আলু চাষী মামুনুর রশিদ কাজল সহ আরো অনেকে আই ফার্মারের প্রতারণার কথা জানান এই প্রতিবেদককে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আই ফার্মারের একাধিক কর্মকর্তা-প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কোম্পানি নিজেদের হিসাব নাম্বারে অর্থ লেনদেন না করে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের হিসাব নাম্বারে আর্থিক লেনদেন করা রহস্যজনক বলেন তারা। এছাড়া ইভালীর মত তাদের আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠানাটির এমন দাবি তাদের।

আই ফার্মারের মার্কেট ফ্যাসিলেটর রাসেল রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি কোন প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে আই ফার্মারের চাকুরী থেকে অব্যাহতি নেয়া রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক কর্মকর্তা আব্দুল মালেক জানান, আই ফার্মার লিমিটেড ক্ষুদ্র কৃষক, খামারী এবং উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী করতে বর্গা পদ্ধতির কথা বলে অর্থ দিলেও পরবর্তীতে ২০% সুদ দাবি করে। উচ্চ সুদ দাবি করায় অনেক খামারী-কৃষকদের সাথে ঝামেলা হয়েছে। এছাড়া আই ফার্মারের ফিল্ডে কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। যার কারণে আমি চাকুরি হতে অব্যাহতি নিয়েছি।

আই ফার্মার লিমিটেডের হেড অব অপারেশন জুলফিকার ফরহাদ রাফেলের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ না করায় কোন মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে কথা হলে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ফাঁকা স্ট্যাম্প ও ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানটির বির“দ্ধে লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্তে অনিয়ম প্রতীয়মান হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

১৬৩ বার ভিউ হয়েছে
0Shares