বৃহস্পতিবার- ২৭শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১৩ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বন ধ্বংস কারী ভোলার সালাম চেয়ারম্যান লাগাম টেনে ধরবে কে ?

বন ধ্বংস কারী ভোলার সালাম চেয়ারম্যান লাগাম টেনে ধরবে কে ?

ভোলা প্রতিনিধিঃ বন ধ্বংস কারী ভোলার সালাম চেয়ারম্যান লাগাম টেনে ধরবে কে ? ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার চর তাজাম্মুলের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সবটুকু বন ধ্বংস করার পর বনদস্যুরা চর নিজামের বন ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে উঠে। চর নিজামের সিংহভাগ বনের গাছ কেটে সেখাে ঘর বাড়ী তৈরি করে নেয়। চর তাজাম্মুলেও একই কায়দায় ঘর বাড়ী তৈরি করে চরটির নতুন নামকরণ করেছে কলাতলীর চর। এখন চর তাজাম্মুলই লাপাত্তা, ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে চর তাজাম্মুল এখন কোথায়? বা এই চরটি কি আদৌ কখনো ছিলো? অথচ বন বিভাগ ১৯৯২-৯৩ অর্থ-বছরে মনপুরার বুক চিরে জেগে উঠা এই চরটিতে বনায়ন করেছিলো। ভোলার সাবেক জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ তাজাম্মুল ইসলামের নামে এই চরটির নামকরণ করা হয়েছিলো ‘চর তাজাম্মুল’। প্রশ্ন উঠেছে বন বিভাগ চর তাজাম্মুলে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে যে বনায়ন করেছিলো সে গাছগুলো এখন কোথায়?

একইভাবে ঢালচর, পূর্ব ঢালচর, বয়ারচর, চর সত্যেন, তারুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে যে বনায়ন করেছিলো সেগুলোরও অনেকটাই রক্ষা রকতে পারেনি তারা। তাহলে বনায়ণ কি করাই হয় ধ্বংসযজ্ঞের মহোৎসব করার জন্য? পরিবেশবাদীদের এমন প্রশ্নের পরও বন বিভাগ বাগান ধ্বংস করেই যাচ্ছে। আর সবকিছুই হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের ছত্রছায়ায়। এই সুযোগে বড় ধরনের ফায়দা লুটে নিচ্ছে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই।

মনপুরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিনের যে বনদস্যু বাহিনী তারাই বিএনপি আমলে চর তাজাম্মুলের বাগান শতভাগ পরিস্কার করে ফেলে। এরপর উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকিরের দস্যুবাহিনী চর নিজামের বাগান ধ্বংস শুরু করে। বর্তমানে ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আঃ সালাম হাওলাদারের দস্যু বাহিনীর চর নিজাম কমান্ডের প্রধান আলম ফরাজীর নেতৃত্বে সেখানে বন ধ্বংস অব্যাহত আছে। এছাড়া ঢালচরে সালাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড মোস্তফা মেম্বার ও ই¯্রাফিল হাওলাদারসহ বনদস্যুরা ঢালচরের মাঝেরচরসহ বিভিন্ন এলাকায় বন ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে আছে। তারা শুধু মহোৎসবই করেনি, মহা রেকর্ডও করেছে। কুকরি-মুকরিতে বনদস্যুরা ২০১০ সালে ১০ হাজার গাছ কেটে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু বর্তমান সালাম বাহিনী ও ঢালচরের শরীফ বাহিনী, কাউছার বাহিনী, কালাম বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী গত ৩/৪বছরে চর নিজাম ও ঢালচরে অন্তত ৫ লক্ষ গাছ কেটে আগের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

বনবিভাগ এসব ঘটনায় ‘আমার কিছুই বলার ছিলো না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম’ গান গেয়েই দায় সাড়েনি তাদের অনেকেই আবার এই মহা রেকর্ডের গর্বিত অংশিদারও হয়েছেন। যদিও তাদের দাবী অনেক বনদস্যুর বিরুদ্ধে তারা মামলা করেছেন। অনেককে হাজতবাস করিয়েছেন। অনেক বন কর্মকর্তা বনদস্যুদের হামলার শিকার হয়েছেন। অনেককে বদলী করা হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাহায্য চেয়েও তারা সাহায্য পাননি। কিন্তু তাদের এমন দাবী ধোপে টিকেনা তখন যখন দেখা যায় বনদস্যুদের এক গ্রæপ গাছ কেটে যায় আর বন কর্মীরা অন্য গ্রæপের সঙ্গে যোগসাজস করে সেই গাছ ইট ভাটায় বিক্রি করে দেয়। এছাড়া বন বিভাগের গৃহীত প্রকল্প সুফলের সুবিধাভোগী হয় যখন বনদস্যুরা তখন স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় বনকর্মীরাও বন রক্ষায় আন্তরিক নন। অসংখ্য বনদস্যু আছে ঢালচরে তারা প্রকাশ্যে বনের গাছ কেটে বাড়ি তৈরি করে আছেন। অথচ বন বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দেয়নি। বরং তাদেরকে সুফল প্রকল্প থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেয়। অথচ বেচারা চুনোপুঁটিরা মামলার শিকার হন। বন বিভাগের কর্মীরা বলেন, স্থানীয় লোকজন যদি তাদের বন রক্ষা না করে আমরা সেই বন রক্ষা করতে গিয়ে কেনো হামলার শিকার হবো। কিন্তু বন রক্ষা করা যে তাদের দায়িত্ব সেটা তারা ভুলে যান। বন দখল করার পর কেনো বনদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না এমন প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছেন না বনকর্মীরা।

যদিও ঢালচর, চর নিজাম এর বিষয়গুলি বন অধিদপ্তরের প্রধান থেকে শুরু করে বরিশাল এবং ভোলার বন কর্মকর্তা সবাই জানেন। এমনকি খোদ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ কায়চার আলম নিজেই বলেছেন, এসব বন ধ্বংসের পেছনে নেতাদের সমর্থন রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনও তাদের সহযোগিতা করে না। এছাড়া গণমাধ্যমে তিনি সালাম বাহিনীর প্রধান ঢালচরের চেয়ারম্যান আঃ সালাম হাওলাদারের নেতৃত্বে বন ধ্বংস হচ্ছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু সালাম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি। মামলা তো দূরের কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছেও লিখিতভাবে কিছু জানাননি। জাতীয় একটি গণমাধ্যমে স্থানীয় লোকজন স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছে সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি কাওছার এবং স্বাস্থ্যকর্মী শরীফ সওদাগর ও নিরব বাহিনীর নির্দেশে তারা বন কেটেছেন। এরপর বনবিভাগের পক্ষ থেকে যারা টিভি সাক্ষাৎকারে এসব বক্তব্য দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। অথচ শরীফ, কাওসার, নিরব কারও বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হয়নি। বরং দস্যুদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গাছ কাটার সুযোগ করে দিয়েছেন। তারপর আবার যখন গাছ কাটতে বাধা দিয়েছেন, তখন বনদস্যুরা গত মাসে রেঞ্চ অফিসার চন্দ্র শেখরকে পিটিয়েছেন। এছাড়া ওই ইউনিয়নের মোস্তফা মেম্বার প্রকাশ্যে জনগনের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছেন, বন কর্মীদেরকে যেনো ঘর থেকে বের হতে দেওয়া না হয়। তাদের কাছে যেনো কোন কিছু বিক্রি করা না হয়। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জনগনকে লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহŸান জানান তিনি। তার বক্তব্যের এই ভিডিওটি ভাইরাল হলেও বন বিভাগ কিংবা অন্য কেউ মোস্তফা মেম্বারকে কিছুই বলেনি। একজন মেম্বার হয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন ঘোষণা দেওয়ার পরও জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে মোস্তফা মেম্বারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বন বিভাগের পক্ষ থেকে রেঞ্চ অফিসার চন্দ্র শেখর এবং সালাম চেয়ারম্যান ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে বন ধ্বংসের এমন অভিযোগ তদন্ত করার জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কায়চার আলম ৫জন রেঞ্চ অফিসার ও ১জন সহকারী বন সংরক্ষককে ঘটনাস্থল তদন্তের জন্য পাঠান। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্টও আলোর মুখ দেখেনি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওই রিপোর্টে সালাম চেয়ারম্যান, রেঞ্চ অফিসার চন্দ্র শেখরসহ অনেক বাহিনীর বনদস্যুদেরকে আড়াল করে একটি দায়সারা রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। সেই রিপোর্টে এমন কাউকে জোড়ালোভাবে অভিযুক্ত করা হয়নি। অথচ বন কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর নিজেই জাতীয় পত্রপত্রিকায় বলেছেন, ঢালচরে ১শত হেক্টর জমির গাছ কেটেছে বনদস্যুরা। কিন্তু তিনি জব্দ করেছেন মাত্র ১২ হাজার গাছ। সেই গাছেরও অনেকটা লাপাত্তা হয়ে গেছে। এছাড়া ১শত হেক্টরে বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২ লক্ষ গাছ থাকার কথা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল এবং ত্রাণ শাখার রাস্তা করতে গিয়ে এসব গাছ কেটেছিলেন সালাম বাহিনীর লোকেরা। অথচ সেই গাছ জব্দ করা হয়নি। তাহলে গাছগুলো গেলো কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে চন্দ্র শেখর বলেন, বনদস্যুরা গাছগুলো মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে। যা খুই হাস্যকর। লালমোহনের লর্ডহার্ডিঞ্জের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের ইটভাটাসহ বিভিন্ন ভাটায় এসব গাছ দেখা গেছে। বন কর্মীদেরকে বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বলার পরও বন বিভাগ কিন্তু সে গাছগুলো জব্দ করেনি। বরং ইটভাটায় পুড়িয়ে গাছ কাটার আলামত নষ্ট করে ফেলতে সহযোগিতা করেছেন।

ঢালচর ও চর নিজামের ম্যানগ্রোভ বাগান ধ্বংসের মহোৎসব চলছে গত কয়েকবছর ধরে। কিন্তু বনবিভাগ কোনভাবেই বন রক্ষা করতে পারছে না। জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে পারছে না, নাকি বনদস্যুদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বন বিভাগও ¯্রােতে ঘা ভাসিয়ে দিচ্ছে? বনদস্যুদের নেতা সালাম চেয়ারম্যানের ভাই ই¯্রাফিল হাওলাদার ও ইউপি সদস্য মোস্তফা কমান্ডার এর দাবী, ঢালচরের নিরীহ মানুষ নদী ভাঙ্গনের কারণে গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। এসব লোকগুলো বন বিভাগকে ম্যানেজ করেই মাঝের চরে ঘরবাড়ী ও দোকান করেছে। তাদের যাওয়ার মতো যায়গা থাকলে তারা এসব করতো না। বনের চেয়ে মানুষের জীবনের দাম বেশি মনে করেই তারা এগুলো করেছেন।

এদিকে সালাম বাহিনীর প্রধান আঃ সালাম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এখন বন বিভাগের জন্য মূর্তমান এক আতঙ্ক। দানব হয়ে দেখা দিয়েছেন বন বিভাগের মাঝে। লক্ষ লক্ষ গাছ কাটার হোতা তিনি। গাছ ধ্বংসকারী এই দানব কোন আইন কানুনই মানেন না। কোন কিছু পাত্তা দেন না। তার দাবী আমিই কি একমাত্র চেয়ারম্যান যে দূর্নীতি করি। আর কেউ কি করে না। তাহলে আমার বিরুদ্ধে এতো নিউজ কোনো। আমি জনপ্রতিনিধি, আমি মনে করি আমার জনগন যদি না বাঁচে তাহলে এই গাছ দিয়ে আমরা কি করবো। স্থানীয় প্রশাসন তাকে খাল খনন, রাস্তা তৈরি, বাজার, কিল্লা তৈরি ও গুচ্ছগ্রামের ঘরসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এসব বরাদ্দ থেকে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হন। সেই লাভের লোভে তিনি বনের গাছ উজার করেন। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত টাকাও তিনি সঠিকভাবে ব্যয় করেন কি না, সে বিষয়ে কোন তদারকি হয় না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল নোমান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আনিছুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন এবং স্থানীয় এমপির সুনজরে থাকা ও চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ঢালচর আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় ধরা কে সরা জ্ঞান করছেন তিনি। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে তাকেও নানাভাবে হয়রানী করেন। তার ক্ষমতার উৎস এতোই শক্ত যে, পরপর তিনবার মেয়াদ উত্তীর্ণ ঢালচরের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরও নানা অজুহাতে তিনি গত ৩ বছর ধরে নির্বাচন বন্ধ রেখেছেন। ইউনিয়নটির ৮০ভাগ এলাকা নদী গর্ভে বিলিন হওয়ার পরও সবকিছু বরাদ্দ পাচ্ছেন পুরো ইউনিয়নের নামে। আর এসব বরাদ্দ নয়ছয় করছেন তিনি। জেলে চাল বিতরণেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আইন অনুযায়ী ইউনিয়নটি বিলুপ্ত করার কথা থাকলেও নামমাত্র ইউনিয়নটিতে বরাদ্দ দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও তাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তার খুটির জোর এতোই বেশি যে স্থানীয় প্রশাসন আজ পর্যন্ত তার টিকিটিও ধরতে পারেনি। এবিষয়ে প্রশাসন ও সালাম চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের দাবী সরকারের যে কোন সংস্থা বনদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।

১০৬ বার ভিউ হয়েছে
0Shares