শনিবার, ৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ফাহিম আমার রিকশাডায় মেলা ধুলা-বালি জমছে। আজকাই পরিষ্কার করন লাগবো।

ফাহিম আমার রিকশাডায় মেলা ধুলা-বালি জমছে। আজকাই পরিষ্কার করন লাগবো।

ছোট গল্প সংগৃহিতঃ

রিকশা চালক মিজানুর তার মেডিকেলে পড়ুয়া ছেলেকে বললো, ” ফাহিম আমার রিকশাডায় মেলা ধুলা-বালি জমছে। আজকাই পরিষ্কার করন লাগবো। আমারে কয় বালতি পানি তুইলা দে আব্বা।”

ছেলে নাক সিঁটকিয়ে জবাব দিলো, “এগুলো কি আমার সাথে যায় আব্বা? তুমি ভাইরে কও। মেডিকেল কলেজে পড়েও যদি তোমার রিক্সা পরিষ্কার করতে হয়, তাইলে শিক্ষার দাম রইলো কই?”

মিজানুর অবাক চোখে চাইলো ছেলের দিকে। গামছা দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বললো, “বাপের রিকশা পরিষ্কার করলে তোর শিক্ষার দাম চইলা যাইবো আব্বা? অথচ এই রিকশার কামাই দিয়াই তোরে আমি শিক্ষিত বানাইলাম।”

পাশ থেকে মা বললেন, “আরে আপনিও না পোলাডার লগে জেরা করতেছেন। কতদিন পর শহর থেইকা আইলো পোলাডা আমার আর আপনি হেরে খালি কা’মে কইতাসেন। আপনার বড় পোলা কই হেরে ডাকেন। তুই আয় বাপ ঘরে ল, এহানে মেলা রোদ।”

ছোট ছেলেকে নিয়ে ঘরে গেলেন মা। পড়াশোনা জানা ছেলে তার, ভবিষ্যৎতে সংসারের হাল ধরার একমাত্র ভরসা। ছেলে তার মস্ত বড় ডক্টর হবে! মায়ের বড় আদরের ছেলে ফাহিম।
তান্মধ্যে, বড় ছেলে কৃষক “সবুজ” আসলো মাঠ থেকে। দূর থেকে এদের খানিকটা কথোপকথন শুনে বাপকে বললো, “আব্বা আপনার কি লাগবে? আমারে কন।”

“একটু পানি উঠান লাগবো আব্বা।”

“ওহ, রিকশা পরিষ্কার করবেন। আইচ্ছা আপনি ঘরে যান আব্বা, আমি এগুলো করতাছি। আপনি একটু জিরাইয়া লন।”

বাবা’কে জোর করে পাঠিয়ে দিলো সবুজ। নিজেই বাবা’র রিকশা পরিষ্কার করে মুছে দিলো। দুপুরে খেয়ে ধান কাঁ’টা’র কাজে যখন যাচ্ছিলো সবুজ। ছোট ভাইকে ডেকে হাসিমুখে বললো,

“ছুডু। আয় দুই ভাই মিইলা একসাথে খ্যাতে যাই আইজ। খ্যাতের ধানতো সব পাইকা গেছে, চল দেখবিনি।”

“তুমি যাও ভাই। আমার ওসব কাজ আর ভাল্লাগে না। আমার একটু বাহিরে কাজ আছে।”

সবুজ আর দাঁড়ালো না। ফাহিম জিন্স, শার্ট, হাতঘড়ি পরে সাহেব হয়ে পাশের বাজারে গেলে একটুখানি হাওয়া খেতে। হঠাৎ করেই কই থেকে যেন ছোটবেলার বন্ধু রোহান এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“কেমন আছিস দোস্ত? কত বছর পর দেখা হলো।”

ফাহিম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, “এই তো ভালো। একটু দূরে সরে দাঁড়া।”

“তুই তো খুব পাল্টে গেছিস ফাহিম। আগের মতো আর নেই।”

“তা একটু বটেই! ঢাকা পড়ছি বুঝিসই তো। তা তুই কি করছিস? পড়াশোনা তো করছিস বলে মনে হয় না। “

“নারে পড়ালেখা আর করা হইলো না। আব্বা মা-রা গেলো সংসারের হাল ধরতে হলো। ওইতো ওপাড়ে এখন রাজমিস্ত্রীর কাজ করছি। চল একসাথে চা খাই।”

ফাহিম আর দাঁড়ালো না। কাজের বাহানা দিয়ে চলে আসলো। একজন রাজমিস্ত্রী তার বন্ধু, লোকে জানলে কি বলবে? তার রেপুটেশন কমে যাবে। শিক্ষিত ছেলে কি-না!
.
.
সময়ের সাথে সাথে ঢাকার মস্ত বড় ডক্টর ফাহিম। বাড়িতে আসে না বহুকাল। বাবা-মায়ের সাথে মাসেও কথা বলার সময় হয়ে উঠে না। মা তিন বছর ধরে অসুস্থ। তাদের দেখাশোনা করছে অশিক্ষিত বড় ছেলেটা। মা ছোট ছেলেকে একবার চোখ ভরে দেখতে চাইলেও তার আসার সময় হয় না। শহুরের বউ-বাচ্চা গ্রামের পরিবেশের সাথে পরিচিত নয়, তাদের অসুবিধা হয়।
মিজানুর স্ত্রীর নড়বড়ে হাতটা শক্ত করে ধরে চোখ মুছছে বারবার। আজ স্ত্রী তার ভীষণ অসুস্থ। মৃ*ত্যু সজ্জায় বসে আবদার করলো, ছোট ছেলেকে দেখার।
সবুজ ভাইয়ের নাম্বারে লাগাতারে কল করছে, রিং হচ্ছে তুলছে না। অনেক ক্ষণ পর ফাহিম ফোন রিসিভ করে বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন,

“ভাই, কি হয়েছে তোমার ? এতো বার কল করে বিরক্ত করছো কেনো? আমি চেম্বারে রোগী দেখছি, তোমার মতো আজাইরা সময় আমার নেই। কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।”

“ছুডু! আম্মা খুব অসুস্থ।”

“তা আমারে বললে কি সুস্থ হয়ে যাবে? ডক্টরের কাছে নিয়ে যাও। সরাসরি বললেই পারো টাকার দরকার, পাঠিয়ে দিবো আজ হাজার দশেক। শহরে বড় ডক্টর দেখিও আম্মাকে। রাখছি।”

“ছুডু কা’টি’স না কল। আম্মা তোরে একবার…..’

তারমধ্যে ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো ফাহিম। সবুজ চোখের জল মুছলো। ভাই তার মস্ত বড় ডক্টর, মায়ের জন্য তার সময় কই?

আজ মা মা-রা গেলো। শেষ দেখাও দেখার সময় হলো না তার ডক্টর ছেলের। শেষ সময় এসেও ওই অবহেলিত কৃষক ছেলেটাই মায়ের দেখাশোনা করছে। আজ মা’কে কবরে রেখে কান্নায় ভে’ঙে পড়লো ছেলেটা। পৃথিবীতে তার আর কেউ রইলো না। মিজানুর ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ছলছল চোখে বললো,

“সন্তান হিসেবে তুই আমার গর্ব আব্বা! তোকে আমি শিক্ষিত করতে না পারলেও মানুষ করতে পারছি। আজকাল শিক্ষিত ছেলেরা বাপ-মায়ের ভালোবাসা, মর্ম বুঝে না। বিদ্যার অহংকারে ভুলে যায় সেসব।”

(সমাপ্ত)

কপি সংগৃহীত

৫২ বার ভিউ হয়েছে
0Shares