বৃহস্পতিবার, ৯ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শাহরিয়ারের হাতে ছিল ‘আলাদিনের চেরাগ’ বিদেশেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন

শাহরিয়ারের হাতে ছিল ‘আলাদিনের চেরাগ’ বিদেশেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন

২৬৪ Views

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি : রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে ২০০৮ সালে প্রথমবার নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন শাহরিয়ার আলম। এরপর টানা ৪বার এই আসনের এমপি ছিলেন। এর মধ্যে ২বার ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে। পেশা ব্যবসায়ী উল্লেখ করে ২০০৮ সালে নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে ঋণগ্রস্ত দেখিয়েছেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী।
এমপি হওয়ার পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত শাহরিয়ারের হাতে ছিল ‘আলাদিনের চেরাগ’। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়ে যান শাহরিয়ার ও তার পরিবারের লোকজন।
শুধু সম্পদই নয় ক্ষমতাও ছিল তার হাতের মুঠোও। যখন যাকে ইচ্ছে করেছেন হয়রানি-নির্যাতন। তার দাপটে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজনসহ নিজ দলের অনেক নেতাকর্মীও কোণঠাসা ছিলেন। তার কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই রেহাই পেতেন না কেউই। তার নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজশাহী জেলা বিএনপির আহŸায়ক আবু সাঈদ চাঁদ গত ১৬ বছরের মধ্যে জেলেই ছিলেন ৭ বছর। এ ছাড়া চাঁদের নামে ৮৫টি মামলা করেন শাহরিয়ারের অনুসারীরা। সংশিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিদেশেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন শাহরিয়ার। এ ছাড়া ক্ষমতা অপব্যবহার করে নিজের পরিবারের লোকজনকেও বানিয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। অন্যের জমি দখল, লুটপাট ও নিয়োগ বাণিজ্য ছিল তার রুটিন মাফিক কাজ। শাহরিয়ারের এসব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন তার এপিএস সিরাজুল ইসলাম।
এলাকাবাসী জানায়, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর এসব জমি ও অর্থসম্পদ গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার তার নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। তিনি তার এপিএস সিরাজের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগেও করেন বাণিজ্য। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারও টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ।
জানা গেছে, রাজশাহীতে নামমাত্র ম‚ল্যে ৬০ কোটি টাকার ৪০ বিঘা জমি জোরপ‚র্বক দখল নিয়ে গড়ে তোলেন অ্যাগ্রোফার্ম। কিনেছেন শতাধিক বিঘা আবাদি জমি। ঢাকাতে রয়েছে কয়েকশ কোটি টাকার আটটি পোশাক কারখানা। রাজশাহী এবং ঢাকায় রয়েছে তার কয়েকটি প্লট এবং ফ্ল্যাট। রাজশাহীতে দুইশ কোটি টাকা ব্যায়ে গড়ে তুলেছেন বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। দেশের গÐি পেরিয়ে রাশিয়া, ব্রাজিল এবং চীনেও রয়েছে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে-দেশের টাকা পাচার করে শাহরিয়ার এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগেও হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এভাবে ১৬ বছরে হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগেই অবস্থা বেগতিক দেখে ৪ আগস্ট রাতেই তিনি গা ঢাকা দেন। ইতোমধ্যে শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে তার নির্বাচনি এলাকা বাঘা এবং চারঘাট থানায় ৮টি মামলা হয়েছে।
জানা যায়, ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় বাঘা-চারঘাটে হঠাৎ করেই আবির্ভ‚ত হন শাহরিয়ার। কিছু খাদ্যসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে মানুষের কাছে পরিচিতি পান গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শাহরিয়ার। এরপর তিনি আওয়ামীলীগের টিকিট নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হন। এ সময় হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার। ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকার। তার নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
২০১৪ সালে চারঘাট সদরের মেরামতপুরে একটি সিনেমা হলের ৩৭ শতক জমি ভবনসহ কোটি টাকা দাম হলেও ক্ষমতার দাপটে মাত্র ৫০ লাখ টাকায় কিনে নেন শাহরিয়ার। ২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভ‚মি অফিসের পাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৩৩ শতাংশ জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। এ ছাড়াও বাঘা, লালপুর ও ঈশ্বরদীতে বিভিন্ন নামে-বেনামে শাহরিয়ারের জমি কেনার আরও তথ্য পাওয়া গেছে।
বাঘার পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুর উপজেলার আওয়ামীলীগের এক নেতার মেয়ে সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহরিয়ার। প্রভাব খাটিয়ে লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজাকে ২০২১ সালে মেয়র বানান শাহরিয়ার। লেনিকে লালপুরে কোটি টাকা ম‚ল্যের বাড়ি করে দেন। ঢাকার গুলশানে লেনিকে ৩ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন। এ ছাড়া গুলশানে নিজের নামে দুটি এবং ছেলের নামে একটি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনি হলফনামায় শাহরিয়ার নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যমতে, তখন শাহরিয়ারের স্থাবর কোনো সম্পদ ছিল না। এ ছাড়া ২০২০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বসন্তপুর মোড়ে একই প্লটে ৪০ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার। ওই জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলা সদরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ-জমির ম‚ল্য পরিশোধ না করে শাহরিয়ার আলম প্রতারণার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন সেই জমি।
এ ছাড়াও লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। ম‚লত শাহরিয়ার আলমের ছোটবেলা কেটেছে লালমনিরহাট জেলায়। সেই সুবাদেই সেখানে জমি কিনে খামারবাড়ি গড়ে তুলেছেন। তার দীর্ঘদিনের এপিএস সিরাজুল ইসলাম সিরাজের বাড়িও কালীগঞ্জ উপজেলায়। শাহরিয়ার আলমের বাবা মো. শামসুদ্দিন ছিলেন রেলের কর্মচারী। সেই সুবাদে তিনি লালমনিরহাটে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।
দেশ ছাড়িয়ে রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গড়েছেন ৮টি পোশাক কারখানা। নিজের রেনেসাঁ গ্রুপের নামে ‘দুরন্ত’ টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এদিকে গত ১৬ বছরে শাহরিয়ার নিজ দলের নেতাকর্মীদের ওপর চালিয়েছেন নির্মম নির্যাতন। রাজশাহী জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য বাঘা-চারঘাটের সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান, বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাস আলী, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজুল ইসলাম মেরাজ, জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল হাসান তুহিন, বাঘা উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোকাদ্দেস আলী এবং বাঘা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রবি, সুরুজ ও মুক্তাসহ অসংখ্য নেতাকর্মী শাহরিয়ারের রোষানলের শিকার হয়েছেন।
যুবলীগের একজন নেতা জানান, আওয়ামীলীগ সরকারে থাকলেও আমরা ছিলাম নিজ এলাকায় পরাধীন। শাহরিয়ারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই শারীরিক নির্যাতন করা হতো। দেওয়া হতো মামলা। প্রত্যেকের নামে ১০-১২টি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারতাম না। নিজ দলের প্রতিবাদী নেতাকর্মীদের কঠোর হাতে দমন করেছেন শাহরিয়ার এবং তার ক্যাডার বাহিনী।
রাজশাহী জেলা বিএনপির আহŸায়ক আবু সাঈদ চাঁদ বলেন, শাহরিয়ার এবং তার সহযোগীরা আমার বিরুদ্ধে ৮৫টি মামলা দিয়েছিলেন। আদালতের বারান্দা আর জেলখানা ছিল আমার বাড়িঘর। গত ১৬ বছরের মধ্যে ৭ বছরই আমি জেলে ছিলাম। বাড়িতে ১ দিনের জন্য আসতে পারিনি। কঠিন জুলুম আর নির্যাতনের শিকার হয়েছি।

Share This