সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভোলার চরাঞ্চলের হাজার হাজার নারীরা স্বাস্থ্য ঝুকিতে

ভোলার চরাঞ্চলের হাজার হাজার নারীরা স্বাস্থ্য ঝুকিতে

Views

মিজানুর রহমান-ভোলা প্রতিনিধিঃ দ্বীপজেলা ভোলার চরাঞ্চলে লবণাক্ততা, সুপেয় পানির অভাব ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে না চলায় হাজার হাজার নারীরা স্বাস্থ্য ঝুকিতে পরেছেন। সোমবার (২৫ নভেন্বর) সরজমিনে অনুসন্ধ্যানে অনেক তথ্য বেড়িয়ে এসেছে।
প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন জেলাগুলোর মধ্যে দ্বীপ জেলা ভোলা অন্যতম। এখানে প্রতিবছর লবণাক্ততার কারণে নারীরা বেশী স্বাস্থ্য ঝুকিতে রয়েছেন, ফসলের উৎপাদন কমছে, বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যাচ্ছে বহু লোকালয় ও জনপদ। ফলে এখানকার বিপন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ঝুঁকিও বাড়ছে দিনদিন। বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট আকার ধারন করছে। নারীর স্বাস্থ্যহানির কারণ অনুসন্ধান করতে ভোলার কয়েকটি চরজনপদে ঘুরে জানা গেছে-তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির নানা চিত্র।
দ্বীপ জেলা ভোলা সদর থেকে প্রায় দু’শ’ কিলোমিটার স্থল ও জলভাগের দূরত্বে অবস্থিত প্রান্তিক চরজনপদ ঢালচর। সেখানে কথা হয় নানান শ্রেণীর পেশার মানুষের সঙ্গে। কয়েক নারী কাঁদামাটি মাখাযুক্ত হয়ে খালে মাছ ধরছেন। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন-৩৮ বছর বয়সী নারী জমিলা খাতুন। এক মেয়ে আর তিন পুত্র সন্তানের জনণী সে। নোনা পানিতে মাছ ধরার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তার। শীত মৌসুম আসলেই মাছ মারার ব্যস্ততা শুরু হয় জমিলার। স্বামী হযরত আলী মাঝি সাগরে গিয়ে মাছ ধরে আনতে পারলে দু’বেলা আহার জুটে,নচেৎ খালে-বিলে মাছ ধরে সংসারের বাকী ঘানি টানতে হয় জমিলাকেই। প্রতিদিন মাছের সঙ্গে আসায় বিষাক্ত নোনা পানির ছোবলে যে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফেটে চৌচির ও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে সেদিক কোনোপ্রকার খেয়ালই রাখেননা জমিলা। শরীরের যতœ নেয়ার জন্য ডাক্তার দেখাচ্ছেননা কেনো জানতে চাইলে শ্রমজীবী নারী জমিলা বলেন, পেটে ভাতই জুটেনা, ডাক্তার দেহায়া ওষুধ খামু ক্যামনে ? সবই আল্লার উপরে ছাইর‌্যা দিছি। বিশোর্ধ্ব অপর নারী লাইলী বেগম কোমরে গামছা বেঁধে খালি পায়ে কাস্তে (কাচি) হাতে নিয়ে চরের জমিতে অন্য নারীদের সঙ্গে ধান কাটছিলেন। মুখে মেছতা পরে বিবর্ণ চেহারা, পায়ে লাল, কালো আর খয়রী বর্নের অসংখ্য চর্ম দাগ তার।
এক কন্যা সন্তানের মা লাইলী বেগম কেনো নিজের শরীরের যতœ নিচ্ছেননা জানতে চাইলে তিনি বলেন,কবিরাজের কাছে গেছি শালশা বানায়া দিছে।

হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার কেনো দেখাচ্ছেননা এমন প্রশ্ন করলে লাইলী বেগম বলেন, এডা ডাক্তারী রোগ না। এইটা বদ জ্বীনের আছর (আক্রমণ)। আরেক নারী মাইমুনাকে দেখা গেছে,পুকুর থেকে কলসিতে পানি ভরতে। পুকুরের পানি নিচ্ছেন কেনো, জিজ্ঞেস করলে মাইমুনা বলেন, পানির কল দুই মাইল দূরে।
জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে উপকূলের চরাঞ্চলে জমিলা, মাইমুনা আর লাইলী বেগমদের মতো এমন অসংখ্য শ্রমজীবী নারী স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়ে ভ্রান্ত ধারনায় নিজের জীবন বিপন্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা হয়, নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সেখানকার বেসরকারী সে¦চ্ছাসেবী সংস্থা কোষ্ট ট্রাষ্টের সমন্বয়করী রাশিদা বেগমের সঙ্গে-তিনি জানান, উপকূলীয় জেলা ভোলার নদী ও সাগরকূলের জনপদ ঢালচরসহ অন্যান্য সকল চর এলাকার পানির লবণাক্ততা ও সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা একই মাত্রার। যার প্রভাব পড়েছে নারীর স্বাস্থ্যে। নারীরা কোমর পানিতে নেমে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা নানান মাছ ও চিংড়িপোনা সংগ্রহ করেন। চর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীরা সহজে স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পান না। সুপেয় পানির জন্য তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। নিজে লবণাক্ত পানি খেয়ে বা কম পানি খেয়ে পরিবারের অন্যদের পান করার জন্য পানি রাখেন। ফলে উচ্চরক্তচাপ,চর্মরোগ, প্রি-একলা¤পশিয়া এমনকি গর্ভপাতের শিকার হন। তিনি আরও বলেন, ওআরএস বা প্যাকেটজাত মুখে খাওয়ার স্যালাইন দক্ষিণাঞ্চলে ততটা কার্যকর নয়।
পরিবারের পুরুষ যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়েন,নারীরা তখন রয়ে যান পেছনে পুরো পরিবার নিয়ে। পরিবারের ছোট বাচ্চা, কিশোরী মেয়ে, বয়স্কদের দায়িত্ব নিতে হয় মায়েদের। এ বিষয় জলবায়ু ফোরামের ভোলা জেলা সমন্বয়ক আবু সিদ্দিক বলেন, সমুদ্রে ডুবোচর জাগছে। মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সংসারের পুরুষটিকে আরও গভীর সমুদ্রে যেতে হয়। নিরাপত্তার কথা ভেবে কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে যেতে হয়। কিশোর ছেলেটিকে দিতে হয় ইটভাটায় বা অন্য কোনো কাজে। কখনও পুরো পরিবার মিলে ইটভাটায় কাজ করে জেলেদের দাদনের টাকা শোধ করতে হয়। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনাপানিতে দাঁড়িয়ে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়। এ ঘটনা গুলো ভোলা উপকূলীয় এলাকার নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের জেলে পরিবারের নারীদের। ঢালচরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আাব্দস সালাম হাওলাদারের জানান, চরের এসব নারীদের অধিকাংশই তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীন।

এ বিষয়ে ভোলার সিভিল সার্জন ডাঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের আরও একটি অভিজ্ঞাতা হচ্ছে ক্রমেই তাপপ্রবাহ বেড়ে চলা। ফলে অত্যাধিক তাপপ্রবাহ নারীর হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। আবার এ তাপপ্রবাহের মধ্যে রান্নাঘরে অনেকটা সময় কাটাতে হয়, যেখানে ধোঁয়া ও তাপ ছাড়াও পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে নারীরা হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া পোশাকের কারণে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীর মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি থাকে। এখানকার ৪০ শতাংশ নারী ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলার সাগর মোহনার চরজনপদ চরফ্যাশন উপজেলায় জনবসতিপূর্ণ, চর ফকিরা, ঢালচর, চর লিউলিন, কুকরি মুকরি, চর পাতিলাসহ ছোট-বড় প্রায় ১১টি চর রয়েছে। এসব চরগুলো মূল ভূ-খন্ড থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। এছাড়া এখানকার উপকূলীয় চর সমূহের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করছে অসংখ্য কিশোর-কিশোরী ও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ। এসব চরাঞ্চলে অধিকাংশই শারীরিক পরিচর্যায় রয়েছে অসচেতন, এতেকরে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে অসংখ্য নারী-কিশোরীরা। তাই এদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

Share This

COMMENTS