
নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন: সমাজের অগ্রগতির অবিচ্ছেদ্য অংশ

নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন কেবল সামাজিক ন্যায়বিচারের অংশ নয়, এটি একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম মূলভিত্তি। সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি জাতির সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান শর্ত। বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা অনেক দেশকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
আধুনিক বিশ্বে নারীর উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে বহু উন্নত দেশ সফলতা অর্জন করেছে। জাপান এ ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে, যেখানে নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে জাপানে নারীদের কর্মসংস্থানে প্রবেশের হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে ১৯৯৯ সালে “Basic Law for a Gender-Equal Society” আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে দেশটিতে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। কর্মজীবী নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় নারীদের অন্তর্ভুক্তি, উদ্যোক্তা সহায়তা, কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি প্রতিরোধ আইনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশেও নারীর উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (SME) নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী শিক্ষা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে, এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যেমন—নারী নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, গৃহস্থালি শ্রমের স্বীকৃতির অভাব, এবং আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামোতে নারীদের আরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে হলে বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই পরিকল্পনার প্রয়োজন। নারীদের প্রতি বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে তাদের ক্ষমতায়নের জন্য শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করতে হবে। কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা সহায়তা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা
নারীর উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মূলত তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে—নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, এবং বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী নারীদের কল্যাণ। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
১. নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা
নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের প্রতিষ্ঠিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন—
- স্বল্প সুদে ঋণ ও সহজ শর্তের অর্থায়ন: অনেক নারী উদ্যোক্তা মূলধনের অভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। তাই সরকার, ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। জাপানে SME (Small and Medium Enterprise) ব্যাংকের মাধ্যমে নারীদের ব্যবসায়িক ঋণ দেওয়া হয় এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য পৃথক ফান্ড গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও একই মডেলে “নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল” গঠন করা যেতে পারে।
- বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা: অনেক নারী ব্যবসা করতে চান, কিন্তু দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে পড়েন। তাই তাদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, বিপণন, ই-কমার্স এবং ডিজিটাল লেনদেনের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
- মহিলা চেম্বার ও সহযোগী সংগঠন: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ চেম্বার ও সহযোগী সংগঠন তৈরি করতে হবে, যা ব্যবসা সম্প্রসারণ, বাজারজাতকরণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণে সহায়তা করবে।
- নারী পরিচালিত স্টার্টআপ ও ব্যবসার জন্য বিশেষ সুযোগ: টেন্ডার, কর ছাড়, প্রদর্শনী ও অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নারীদের ব্যবসার জন্য অগ্রাধিকারমূলক নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
২. নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ
নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের সমস্যা নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায়। কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ কর্মক্ষেত্র ও সমাজে নারীদের প্রতি বিদ্যমান সহিংসতা। এটি প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি—
- কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ: নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি ও শিশু বিয়ে রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জাপানে DV (Domestic Violence) আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন নির্যাতিত নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ও আইনি সহায়তা প্রদান করে। বাংলাদেশেও এই ধরনের কেন্দ্র ও আইনি সহায়তার সুযোগ আরও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
- নারীদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি: কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন ও জনসমাগমস্থলে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে কিছু ট্রেনে শুধু নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কামরা থাকে, যা বাংলাদেশেও চালু করা যেতে পারে।
- নারীদের জন্য হেল্পলাইন ও আশ্রয়কেন্দ্র: জরুরি সহায়তার জন্য নারী নির্যাতন প্রতিরোধ হেল্পলাইন চালু এবং তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে হবে। জাপানের মতো বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ও কাউন্সেলিং সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
৩. বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী নারীদের কল্যাণ
প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য একটি সুসংহত নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। এই অংশের অধীনে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে—
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ: সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করা যেতে পারে। জাপানে “Long-Term Care Insurance (LTCI)” নামে একটি ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য আর্থিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। বাংলাদেশেও একটি টেকসই পেনশন ও বীমা কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে।
- গৃহস্থালি নারীদের জন্য পেনশন সুবিধা: দীর্ঘদিন ধরে যারা গৃহস্থালি কাজে যুক্ত ছিলেন, তাদের জন্য সরকারি পেনশন সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
- প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারীদের পুনর্বাসন: প্রবীণ বা বিশেষভাবে সক্ষম নারীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গঠন, চিকিৎসা সহায়তা ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন: একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ
নারীর ক্ষমতায়ন কেবল তাদের নিজস্ব উন্নতির জন্যই নয়, বরং সমাজ ও জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের নেতৃত্বের সুযোগ বৃদ্ধি, তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি—এই তিনটি বিষয় নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে জাপানে, নারীদের নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নের জন্য নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলাদেশেও নারীর ক্ষমতায়নকে আরও কার্যকর করতে হলে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
১. নারীদের নেতৃত্বের অবস্থান বৃদ্ধি
নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধি করা মানে কেবল তাদের উচ্চ পদে বসানো নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা। এজন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের উদ্যোগ প্রয়োজন।
- কোটা ব্যবস্থা ও নীতিগত সহায়তা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে কর্পোরেট বোর্ডে অন্তত ৩০% নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উচ্চপদে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। - নারী নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন
নেতৃত্বের জন্য দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। তাই, নারীদের জন্য আলাদা নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে, যেখানে ব্যবসা পরিচালনা, নীতিনির্ধারণ, এবং সংকট ব্যবস্থাপনা শেখানো হবে। - রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি
নারীরা যদি রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হন, তাহলে তারা আইন ও নীতিনির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাই নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন এবং নারীদের জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমর্থন প্রদান করতে হবে।
২. নারীদের অধিকার সুরক্ষা
নারীদের কর্মক্ষেত্রে ও পরিবারে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে।
- কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ
অনেক কর্মক্ষেত্রে এখনো নারীরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হন। একই ধরনের কাজের জন্য নারী ও পুরুষের সমান বেতন নিশ্চিত করা জরুরি। - মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা
জাপানে কর্মজীবী নারীদের জন্য ১৪ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশেও এই সুবিধাগুলোকে আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, যাতে কর্মজীবী মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। - নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ
অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি ও অসদাচরণের শিকার হন। তাই, কর্মস্থলে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং অভিযোগ জানানোর জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩. সমান সুযোগ সৃষ্টি
নারীদের কর্মসংস্থান ও শিক্ষায় সমান সুযোগ তৈরি করা জরুরি। সমাজে নারীদের দক্ষতার মূল্যায়ন ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা গেলে তারা আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।
- শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগ
নারীরা যদি উচ্চশিক্ষায় পর্যাপ্ত সুযোগ পান, তাহলে তারা ভবিষ্যতে উচ্চপদে যাওয়ার জন্য আরও বেশি সক্ষম হবেন। তাই, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বৃত্তি ও অনুদান বাড়ানো প্রয়োজন। - কর্মসংস্থানে নারীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ
- নারীদের জন্য হোম-অফিস, ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ার এবং রিমোট ওয়ার্ক সুবিধা চালু করা যেতে পারে, যাতে তারা পরিবার ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারেন।
- নারীদের টেকসই উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।
- পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন
নারীদের নেতৃত্ব ও কর্মসংস্থানে সুযোগ বাড়ানোর জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের দক্ষতা ও সক্ষমতাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
নারী উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন
নারী উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং ক্ষমতায়ন একটি দেশের সার্বিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে দেশ আরও সমৃদ্ধ হবে। উন্নত বিশ্বে যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এবং ইউরোপীয় দেশগুলো নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, বাংলাদেশেও নারীর উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
নারীদের কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন
বাংলাদেশে নারীদের কর্মসংস্থান এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশেষ করে শহরের বাইরে এবং গ্রামীণ অঞ্চলে নারীরা এখনো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—
১. সরকারি প্রণোদনা ও নীতিগত সহায়তা
সরকার যদি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা ও সহায়তা প্রদান করে, তাহলে তারা আরও বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে।
- বিশেষ বাণিজ্যিক সুযোগ প্রদান
- নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বাণিজ্য মেলা, এক্সপোর্ট সুবিধা ও ট্যাক্স রেয়াত নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
- ভারতে “Mahila E-Haat” নামে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে, যেখানে নারী উদ্যোক্তারা সরাসরি তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন।
- বাংলাদেশেও একটি ডিজিটাল ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে নারী উদ্যোক্তারা বিনামূল্যে তাদের পণ্য প্রদর্শন করতে পারবেন।
- স্বল্প সুদে ঋণ ও অর্থনৈতিক সহায়তা
- জাপানে SME ব্যাংকের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়।
- বাংলাদেশেও “নারী উদ্যোক্তা তহবিল” গঠন করা হলে নারীরা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।
২. নারীদের প্রযুক্তি খাতে প্রবৃদ্ধি
প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণের হার এখনও কম। তবে এই খাতের প্রসার নারীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
- প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি
- “Women in Tech” কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, যেখানে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং ও সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
- জাপানে “Women Who Code” কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের প্রযুক্তি খাতে দক্ষ করা হয়, যা বাংলাদেশেও গ্রহণ করা যেতে পারে।
- অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ সহায়তা
- নারীদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ ও স্টার্টআপ তহবিল প্রদান করা যেতে পারে।
- বিশেষত ই-কমার্স ও ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে তারা ঘরে বসেই আয় করতে পারবে।
৩. কর্মস্থলে জেন্ডার সমতা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
নারীদের কাজের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
- নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা
- জাপানে কিছু প্রতিষ্ঠান পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করেছে, যা পরিবারে লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্ব ভাগ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- বাংলাদেশেও পিতৃত্বকালীন ছুটি চালু করা গেলে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে।
- নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি
- নারীদের কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি প্রতিরোধের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
- কোম্পানিগুলোতে “Internal Complaint Committee (ICC)” গঠন করা হলে নারীরা সহজেই অভিযোগ জানাতে পারবেন।
- কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার এবং নারী কর্মীদের জন্য পৃথক বিশ্রাম কক্ষ তৈরি করা যেতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা
নারীর ক্ষমতায়ন শুধু কর্মসংস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করাও জরুরি।
১. নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ
নারীদের জন্য নিরাপদ সমাজ গঠন করা জরুরি।
- নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন আরও শক্তিশালী করতে হবে।
- জাপানে DV (Domestic Violence) আইন বাস্তবায়নের ফলে নারী নির্যাতনের হার কমেছে, বাংলাদেশেও এমন কঠোর আইন কার্যকর করা দরকার।
- নারীদের জন্য আরও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ও কাউন্সেলিং সেন্টার তৈরি করা যেতে পারে।
২. নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
- ক্ষুদ্র ঋণ ও উদ্যোক্তা সুবিধা বাড়ানো গেলে নারীরা স্বাবলম্বী হতে পারবেন।
- সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কোটা, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।
নারীর নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি
নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের অবদানের স্বীকৃতিও জরুরি।
১. নারী উদ্যোক্তা সহায়তা তহবিল
- নারীদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য পৃথক তহবিল গঠন করা প্রয়োজন।
- এই তহবিলের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।
২. গৃহস্থালি নারীশ্রমের স্বীকৃতি
- সংসারে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
- জাপানে গৃহিণীদের জন্য পেনশন সুবিধা রয়েছে, যা বাংলাদেশেও চালু করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে নারীদের বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও, এখনও অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছেন। সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০,৯৭,৩৩৪টি, যার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩,১৩৩, অর্থাৎ মোট কর্মীর মাত্র ৭.৬% নারী। উচ্চ প্রশাসনিক পদ, যেমন উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে নারীর সংখ্যা মাত্র ১% বা তারও কম। জাতীয় ও স্থানীয় বিচার বিভাগে বিচারকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০%। তবে, হাইকোর্টে এখনও কোনো নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাননি।
এছাড়াও, বাংলাদেশের নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ লাখ, যারা প্রায়ই মজুরি বৈষম্যের শিকার হন। একই কাজের জন্য পুরুষ শ্রমিকরা গড়ে ১৮৪ টাকা পেলেও নারী শ্রমিকরা পান ১৭০ টাকা। এই বৈষম্য নারীদের সমাজে অবমূল্যায়িত করার ইঙ্গিত বহন করে, যা তাদের উন্নয়ন ও স্বাধিকার অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তবে, বাংলাদেশের নারীরা নানা ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রমাণ করছেন। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে নারী নেতৃত্বের ভূমিকা বাড়ছে, যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু নারীদের ক্ষমতায়ন ও উন্নতির জন্য বাংলাদেশের পথ এখনও অনেক দূর। যখন আমরা উন্নত দেশগুলোর পরিস্থিতি দেখি, তখন আমাদের বুঝতে হবে যে, নারীরা শুধু তাদের নিজ দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে সবক্ষেত্রে শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে, নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন, নরওয়ে এবং ডেনমার্কে নারীদের শশক্তিকরণ প্রক্রিয়া অনেক উন্নত এবং এসব দেশে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্যও বাংলাদেশ অপেক্ষা অনেক কম। সুইডেনে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ৭৭%, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। এসব দেশে নারীরা শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্তরেও সমানভাবে অংশগ্রহণ করছেন।
বাংলাদেশে নারীদের ক্ষমতায়ন এখন সময়ের দাবি। কর্মক্ষেত্রে তাদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, মজুরি বৈষম্য দূর করা এবং উচ্চপদে নারীদের উপস্থিতি বাড়ানো শুধু ন্যায়সংগত নয়, বরং দেশের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। নারীরা পিছিয়ে থাকলে জাতির সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে—নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করে, তাদের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। এটা কোনো অনুগ্রহ নয়, বরং জাতীয় অগ্রগতির পূর্বশর্ত!
উপসংহার
নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে এসব উদ্যোগকে আরও কার্যকর করতে হলে বাস্তবমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। বিশ্বে যে জাতি নারীদের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছে, সেই জাতিই উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে—বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতে পারে না। সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ, উদ্যোক্তা সহায়তা ও সিদ্ধান্তগ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ যদি এই মডেল অনুসরণ করে, তবে দেশের নারী সমাজ আরও স্বাবলম্বী হয়ে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হবে। নারীর ক্ষমতায়ন শুধু তাদের ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তাই এখনই সময় নারীদের এগিয়ে নেওয়ার, এখনই সময় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ার!