সিরাজগঞ্জের চলনবিলে সরিষা ও মধু উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে
এইচএম মোকাদ্দেস,সিরাজগঞ্জ :; সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর ও নওগাঁ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল। এক বিরল প্রাকৃতিক জলসম্পদে ভরা এই বিলটি এক সময় বছরের ৯ মাস পানিতেই ডুবে থাকত। এই বিল তার বিশাল জলরাশির ঐতিহ্য হারিয়েছে। সেই সাথে বিলের তলা উন্মোচিত হয়ে সরিষা আবাদ ও মধু সংগ্রহের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে এই চলনবিল।
চলনবিলের বুকজুড়ে এই রবি মৌসুমে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হচ্ছে। সেই সরিষাফুল থেকে আহরিত হচ্ছে অনন্য সম্পদ মধু। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রায় আড়াই হাজার টন মধু ও তিন লাখ টন সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই মধু দেশে এবং দেশের বাইরে রফতানি হচ্ছে বলে জানান মধু সংগ্রহকারীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানাযায়, চলতি রবি মৌসুমে পাবনায় ৪৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর, নাটোরে ৯ হাজার ১১৫ হেক্টর, নওগাঁয় ৬০ হাজার ১০০ হেক্টর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ৮৭ হাজার ১২৫ হেক্টর মিলে মোট দুই লাখ এক হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবী জাতের সরিষার আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে মোট চার লাখ দুই হাজার ৪৬০ টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবার। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। চলনবিলের বুক চিরে ছুটে চলা বনপাড়া-হাটিকুমরুল যমুনা সেতু সংযোগ মহাসড়কের দুই ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্ত রেখায়। নয়নাভিরাম সেই সরিষা ক্ষেতের আলে আলে সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে মৌবাক্স। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মধু সংগ্রহের পাশাপাশি সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান কৃষি সংশ্লিষ্টরা। গোটা চলনবিল এখন সত্যিকার অর্থে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মধু উৎপাদনে চলনবিল এখন নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে। চলতি মৌসুমে গোটা বিলাঞ্চল থেকে ২৫ লাখ কেজি (আড়াই হাজার টন) মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মৌচাষিরা আশা প্রকাশ করছেন। প্রতি কেজি ৪০০ টাকা হিসেবে এর বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। চলনবিলে প্রায় এক হাজার মৌচাষি মধু সংগ্রহে এসেছেন। আর এসব মৌচাষির সাথে শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছেন আরো তিন হাজার ।
পাবনা নাটোর ও সিরাজগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে চলনবিলের ২৬টি উপজেলায় এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের সরিষার চাষ হয়েছে। এ অঞ্চলে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অন্য দিকে মধুমক্ষির আনাগোনায় পরাগায়ন ভালো হওয়ায় সরিষার ফলনও বাড়ছে। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ-পৌষ-মাঘ জুড়ে চলনবিলের মাঠগুলো সরিষা ফুলে ভরে থাকে।
চলনবিল পাড়ের আলাইপুর গ্রামের কৃষক সুশান্ত কুমার শান্ত বলেন, এ বছর তিনি ৭৫ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় সাত থেকে আট মণ সরিষা পাওয়ার আশা করছেন তিনি। সরিষা চাষের পাশাপাশি তিনি নিজেও মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন। দলগাসা গ্রামের কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, তিনি এ বছর বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন। তিনি নিজে মৌবাক্স না বসালেও অন্যরা এসে তার ক্ষেতেও মৌবাক্স বসিয়েছে। এতে সরিষার ফলন ভালো হওয়ার আশা করছেন তিনি। ঐতিহ্যবাহী কলম গ্রামের কৃষক রমজান আলী জানান, অন্যান্য ফসল আবাদ করে যে পরিমাণ লাভ করা যায়, তার চেয়ে একই পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃৃতিক সৌন্দর্য ও মধু।
খুলনা থেকে চলনবিলের কলম এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা নাছির উদ্দিন বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মধু আহরণ করছেন। গত বছর তিনি এই চরাঞ্চলে এসে দুই টন মধু সংগ্রহ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া ভালো, তাই তিনি এবার তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরষের পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়।
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আ,জা,মু আহসান শহীদ সরকার বলেন, প্রতি বছর চলনবিল এলাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌচাষিরা আসেন। তাদের সংগৃহীত মধু পাইকাররা কিনে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। এবার অনুকূল আবহাওয়ায় সরিষার বাম্পার ফলনের পাশাপাশি মধু আহরণের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।