বিদ্যুৎ খাতের বড় বোঝা ক্যাপাসিটি চার্জ
বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে জরুরিভাবে চালু করা রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে এখন হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি। অনেকটা বসিয়ে রেখেই দিনের পর দিন ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ওসব কেন্দ্রকে।
চলতি অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই গেছে রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালন ব্যয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা কারণে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বেশিরভাগ অর্থই এসব বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ মেটাতে ব্যয় করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও তাদের উৎপাদনক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট ফি কেন্দ্রগুলোকে দিতে হয়, যার পুরোটাই সরকারকে বহন করতে হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মোট এক লাখ ছয় হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা ভর্তুকির মধ্যে বিদ্যুৎ খাত পেয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ৩২ হাজার কোটি টাকা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধেই খরচ হয়েছে। তারপরও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আর গ্রিড যুগোপযোগী করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৪ হাজার সার্কিট কিলোমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম হিসেবে ‘ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান (আইপিএমপি) প্রণয়ন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আঞ্চলিক ও উপণ্ডআঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যক্রমের আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর গ্রিড আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে বাংলাদেশের গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের মোট ভর্তুকির যদি বড় একটা অংশ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধেই ব্যয় হয়, তাহলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। সূত্র জানায়, দেশজুড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের নামে কয়েক বছর যাবত বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিচালিত হচ্ছে ‘কৃচ্ছ্র’ অভিযান। কৃচ্ছ্রর নামে কয়েক বার কমানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও। ফলে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জীবনযাপন করতে হয়েছে মানুষজনকে। তবুও বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বরং দিনের পর দিন বসিয়ে রেখে পরিশোধ করা হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলা হলেও ‘মেইনটেনেন্স কস্ট’ বা পরিচালন ব্যয়ের নামেই সরকারের কোষাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতেই গত বছরগুলোতে আরও কয়েকটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়। মেয়াদ বাড়ানোর সময় ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ শর্তের কথা বলা হলেও ভিন্ন নামে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন মালিকরা।
১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছরে বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় ২৫ হাজার ৩১ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এজন্য পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ৬৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ছিল পিডিবির ইতিহাসে রেকর্ড। ওই সময়ে শীর্ষ ১২টি কোম্পানিকে আট হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।
এত বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার জন্য মোট ৪৯ হাজার ৩৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এর অধিকাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে ২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২৫ হাজার ৫৬৪ মেগাওয়াট। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এ অবস্থায় বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই চুক্তি অনুযায়ী তথাকথিত ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাবদ প্রতি বছর গড়ে ৫-৭ হাজার কোটি টাকা করে গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে।
এদিকে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বারবার প্রশ্ন করেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলেও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয় অর্থাৎ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানের খরচ সরকারকে বহন করতে হয় বলে স্বীকার করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আমাদের জিডিপিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জরুরি প্রয়োজনে ২০০৯ সালের পর থেকে এই কেন্দ্রগুলো অনিবার্য ছিল, এখন নেই। তাই বর্তমানে এগুলো চলছে ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ নীতিতে। মানে এখান থেকে বিদ্যুৎ কেনা হলে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে। না ব্যবহার হলে দেয়া হবে না। তবে তাদের মেইনটেন্যান্স খরচ দিতে হচ্ছে। তা পরিমাণে খুবই সামান্য। একটি কেন্দ্রে যে কয়জন চাকরি করছে, তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পরিচালন যা টাকার অঙ্কে খুব বড় কিছু নয়।