বাংলাদেশের মিডিয়া, বিশেষ করে সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিভৎস ছবি বা রক্তাক্ত ছবির সংখ্যা বাড়ছে, যা গভীর সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলছে। এসব ছবি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য মিডিয়াগুলির একটি জনপ্রিয় উপায় হয়ে উঠেছে। কিন্তু, এর পেছনে আছে এমন কিছু কারণ যা শুধুমাত্র দৃষ্টির আনন্দ নয়, বরং মানুষের মানসিকতা ও সামাজিক সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিভৎস ছবি ও রক্তাক্ত ছবির মূল কারণ:
১. বাণিজ্যিক উদ্বুদ্ধতা
মিডিয়া চ্যানেলগুলো সবসময় তাদের পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে। আর এই উদ্দেশ্যে তারা এমন বিষয়বস্তু প্রকাশ করে যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। রক্তাক্ত এবং বিভৎস ছবি মানুষের মনোযোগ দ্রুত আকর্ষণ করে, যেহেতু এই ধরনের ছবি বিশেষত বিভ্রান্তিকর এবং উত্তেজনাপূর্ণ হয়। এই ছবিগুলোর মাধ্যমে তারা বিজ্ঞাপন বা অন্যান্য প্রচারণা কার্যক্রমের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ট্র্যাজিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার মাধ্যমে টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) বাড়ানো হয় এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়।
এই ধরনের ছবি শুধু মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মুনাফা বাড়ায় না, বরং এটি সমাজে পেশাদারিত্বের অভাব সৃষ্টি করতে পারে। একদিকে, এটি খবরের সঠিকতা বা সার্বিক মূল্যায়নকে উপেক্ষা করে, অন্যদিকে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
২. মানসিক প্রভাব এবং সেনসেশনালিজম
বর্তমান সমাজে সেলিব্রেটি সংস্কৃতি এবং "সেন্সেশনালিজম" প্রবণতা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেনসেশনালিজম বলতে এক ধরনের উত্তেজনা বা হইচই সৃষ্টি করা হয়, যাতে মানুষকে অবাক বা বিস্মিত করা যায়। মিডিয়াতে কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধের রক্তাক্ত ছবি প্রকাশ করার মাধ্যমে এই ধরনের উত্তেজনা তৈরি করা হয়। জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে, মিডিয়া এসব ঘটনার ছবি এমনভাবে উপস্থাপন করে যা একদিকে মানবিক সহানুভূতির সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে তা দর্শকদের মানসিকতায় অবিশ্বাস্য বা মর্মান্তিক আঘাত সৃষ্টি করে।
এ ধরনের ছবি মানুষের মনে এক ধরনের অবসাদ বা শক তৈরি করতে পারে, যার ফলে তারা এসব ঘটনার দিকে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে, এটি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং অনেকে এর প্রতি এক ধরনের আবেগগত আসক্তিতে পরিণত হয়, যা শেষ পর্যন্ত এক ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা সৃষ্টি করে।
৩. তথ্য সংক্রমণ এবং অপরাধের চাহিদা
মিডিয়াতে ট্র্যাজিক বা ভীতিকর ঘটনা প্রচারিত হলে তা মানুষের মধ্যে সারা দিবস আলোচনা এবং শেয়ার করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ধরনের ছবি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা মানুষকে আরও বেশি শেয়ার করতে উদ্বুদ্ধ করে। এই তথ্যের মাধ্যমে একটি ভীতি বা উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়, যা কখনও কখনও অপরাধের আশঙ্কা বা একধরনের সামাজিক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। যখন মিডিয়া ঘন ঘন এই ধরনের চিত্র প্রকাশ করে, তখন এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বা চিন্তার পরিবর্তনের বদলে উদ্বেগ এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
এর ফলে অপরাধ সম্পর্কিত চাহিদা বাড়ে, যেমন- মানুষ অপরাধ বা ট্র্যাজেডি সম্পর্কিত আরও তথ্য জানতে চায় বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। এটি সমাজে একধরনের অপরাধমূলক মনোভাব বা আগ্রহ তৈরি করতে পারে, যেটি দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে। মিডিয়া এই ছবিগুলি প্রকাশ করে একদিকে উপার্জন করতে চায়, তবে অপরদিকে তা সমাজে অস্থিরতা এবং অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. অনুভূতিগত অবক্ষয়
বিভিন্ন সময়ে, মিডিয়া এমন ছবির মাধ্যমে সামাজিক অনুভূতিগুলিকে অবহেলা করে, যা মানুষের অভ্যন্তরীণ মানবিক অনুভূতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রক্তাক্ত বা বিভৎস ছবির দর্শন মানুষের সহানুভূতির অনুভূতি কমিয়ে দেয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা এমন দৃশ্যগুলির প্রতি আরো অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এর ফলে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতি কমে গিয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতি হতে পারে।
এভাবে বিভৎস ছবি এবং রক্তাক্ত চিত্রের প্রকাশনা দীর্ঘকাল ধরে মিডিয়া এবং সমাজের মধ্যে একটি নেতিবাচক চক্র তৈরি করতে পারে, যা সমাজের মানসিক অবস্থান এবং সমষ্টিগত স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
মানব সমাজের উপর ক্ষতিকর প্রভাব:
বিভৎস ছবি এবং রক্তাক্ত ছবি সমাজে গভীর, নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই ধরনের ছবি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে, কিন্তু এর সাইকোলজিকাল, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলি ব্যাপক এবং দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে।
১. মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, রক্তাক্ত বা বিভৎস ছবি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত, শিশু এবং তরুণরা যখন এই ধরনের ছবি দেখে, তাদের মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ধরনের দৃশ্য সাধারণত ভয়, উদ্বেগ, অবসাদ বা বিষণ্নতা সৃষ্টি করে এবং এটি মানসিক দুর্বলতার সৃষ্টি করতে পারে।
অপরাধী মনোভাব বা হিংস্রতা বেড়ে যেতে পারে, কারণ এই ছবিগুলি মানুষের মধ্যে সহানুভূতি বা সহমর্মিতার অনুভূতিকে কমিয়ে দেয়। শিশুদের ক্ষেত্রে, তাদের মস্তিষ্ক এখনো বিকাশমান, তাই তারা এই ধরনের দৃশ্য দেখে আরও বেশি প্রভাবিত হতে পারে। ফলে তারা সহানুভূতি হারাতে পারে এবং অস্থির বা সহিংস মনোভাব ধারণ করতে পারে।
এছাড়া, নির্দিষ্ট ধরনের ছবি যেমন, হত্যাকাণ্ড বা দুর্ঘটনা দেখতে দেখতে মানুষ রূঢ় হয়ে উঠতে পারে এবং তারা এসব ঘটনায় অন্যদের কষ্টকে অনুধাবন করতে পারে না, যার ফলে সমাজের মধ্যে সহানুভূতির অভাব দেখা দেয়।
২. সম্প্রতি প্রজন্মের প্রতি ক্ষতিকর প্রভাব
আজকের তরুণ প্রজন্মের প্রতি এই ধরনের ছবির প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর। যেসব শিশুরা বা তরুণরা নিয়মিতভাবে রক্তাক্ত বা সহিংস ছবি দেখে, তারা এক ধরনের সহিংস মনোভাব গড়ে তুলতে পারে। গবেষণা প্রমাণ করে যে, সহিংস ভিডিও গেমস বা ছবির প্রতি আগ্রহী হওয়া শিশুদের মধ্যে বাস্তব জীবনে সহিংস আচরণ প্রদর্শন করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এটি পরবর্তীতে তাদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই তরুণরা সমাজে সহিংসতা, আক্রমণ, বা সহিংস সমাধানের দিকে ঝুঁকতে পারে। এছাড়া, তাদের মধ্যে অ্যালকোহল বা মাদকের ব্যবহার, আত্মহত্যা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে প্রবণতা বাড়তে পারে।
এছাড়া, সমাজে মনোভাবগত বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে, কারণ এই ধরনের ছবি শিশুরা তাদের মানসিক অবস্থা ও মূল্যবোধের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে তারা নানা ধরনের নেতিবাচক আচরণ বা সামাজিক অস্থিরতায় নিপতিত হতে পারে।
৩. সম্প্রদায়িক বা জাতিগত বিশৃঙ্খলা
বিভিন্ন রাজনৈতিক বা জাতিগত উত্তেজনা তৈরি করার জন্য রক্তাক্ত বা বিভৎস ছবি একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কিছু ছবির মাধ্যমে বিশেষ জাতি, ধর্ম, বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়, যা সমাজে জাতিগত বা ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করতে পারে।
যেমন, যদি কোনো জাতিগত সহিংসতার ছবি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, তাহলে সে সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের সহানুভূতি কমে যেতে পারে, অন্যদিকে বিদ্বেষ এবং দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই ধরনের ছবি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় না, বরং এটি মানুষকে ভুল ধারণা দিতে এবং সন্ত্রাসবাদ, জাতিগত সংঘর্ষ বা ধর্মীয় অশান্তি উসকে দিতে পারে।
এমনকি এই ধরনের ছবি আন্তর্জাতিক বা জাতিগত সম্পর্কের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যেখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বিপদজনক বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে।
৪. সামাজিক অস্থিরতা
এ ধরনের ছবি সমাজের মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। যখন একটি ঘটনা বা ট্র্যাজেডি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়, তখন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বা ভয় সৃষ্টি করতে পারে। জনগণ এমন পরিস্থিতিতে মনোযোগী হয়ে উঠে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অসন্তোষ এবং আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
এই ধরনের ছবি শুধুমাত্র আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে না, বরং এটি সমাজের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একটি জাতির ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এটি বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৫. গণমনোভাবের পরিবর্তন
বিভৎস ছবি এবং রক্তাক্ত চিত্রগুলি গণমনোভাব পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব ছবি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব এবং অনুভূতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষত, এই ধরনের ছবি যখন জনসমক্ষে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেগুলি জনগণের মানসিকতায় স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া, এটি একটি প্রবণতা তৈরি করে, যেখানে জনসাধারণ আরও বেশি সহিংস বা নেতিবাচক বিষয়বস্তু দেখতে চাইতে পারে, যা গণমাধ্যমের দিকেও তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে, এটি সম্পূর্ণভাবে সামাজিক মূল্যবোধ এবং সহানুভূতির প্রতি একধরনের অবহেলা সৃষ্টি করতে পারে।
৬. মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
এ ধরনের ছবি দেখলে সমাজের মানবিক মূল্যবোধও অবক্ষয়ের সম্মুখীন হতে পারে। সহানুভূতি, নৈতিকতা, এবং মানবিকতা সমাজের ভিত্তি, কিন্তু রক্তাক্ত এবং বিভৎস ছবির মাধ্যমে এই মূল্যবোধ কমে যেতে পারে। মানুষ এমন ছবি দেখে কিছুটা রূঢ় হয়ে যায় এবং অন্যের কষ্টের প্রতি তাদের অনুভূতি হ্রাস পায়। এটি শুধু শিশু ও তরুণদেরই নয়, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বড় ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টি করে।
এভাবে, বিভৎস ছবি এবং রক্তাক্ত চিত্রগুলো সমাজে মানবিকতা ও সহানুভূতির পতন ঘটাতে পারে, যা দীর্ঘকাল ধরে মানুষের জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করতে পারে।
যৌক্তিক পদক্ষেপ:
বিভৎস বা রক্তাক্ত ছবি প্রকাশের সমস্যা মোকাবিলায় কিছু যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যা সমাজে সুষ্ঠু এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে। এই পদক্ষেপগুলি নিশ্চিত করবে যে মিডিয়া গুলো আরও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করবে এবং সমাজে নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনবে।
১. এডিটোরিয়াল গাইডলাইন তৈরি
মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত একটি সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর এডিটোরিয়াল গাইডলাইন তৈরি করা, যা হিংসাত্মক বা বিভৎস ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করবে। এই গাইডলাইনগুলিতে মূলত তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
এ ধরনের গাইডলাইন তৈরি হলে, মিডিয়াগুলো নিজেদের সংবাদ পরিবেশনার প্রক্রিয়া আরও সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে এবং এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করবে, যে কোন ঘটনা বা ছবি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মানবিক দিকের প্রতি দায়িত্বশীল থাকতে হবে।
২. পাঠ্যবই এবং মিডিয়া শিক্ষা
বর্তমান প্রজন্মকে মিডিয়া বিষয়ে সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি। মিডিয়া সোর্সের সঠিক ব্যবহার শেখানো এবং সঠিক তথ্য গ্রহণের গুরুত্ব বুঝানো ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তরুণদের শেখানো উচিত:
এই ধরনের শিক্ষা সমাজের তরুণদের আরও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। একইভাবে, এটা তাদের শিখাবে কিভাবে বিশ্বস্ত এবং সঠিক মিডিয়া সোর্স থেকে তথ্য গ্রহণ করতে হবে, যা সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব থেকে তাদের রক্ষা করবে।
৩. মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা
বিভিন্ন শোকাবহ বা ট্র্যাজিক ঘটনা যখন মিডিয়াতে প্রচারিত হয়, তখন তা মানুষের মানসিক অবস্থা এবং তাদের অনুভূতির উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে অনেক মানুষ মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। তাই, এই ধরনের ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে, সহানুভূতির সাথে এবং যথাযথ মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার মাধ্যমে এটি উপস্থাপন করা উচিত।
৪. বহির্বিশ্বের উদাহরণ
বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে এই ধরনের ছবি এবং সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি রয়েছে, যা আমাদের জন্যও একটি প্রেরণা হতে পারে। যেমন:
এছাড়া, এসব দেশগুলোতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ সেশনও পরিচালিত হয়, যেখানে মিডিয়া কর্মীরা প্রতিদিনের কনটেন্ট প্রকাশের আগে মানবিক দিক এবং সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে অবগত হন।
উপদেশ:
বিভৎস এবং রক্তাক্ত ছবি প্রকাশের সমস্যাটি একটি জটিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়, যা শুধুমাত্র সরকারের একক প্রচেষ্টায় সমাধান সম্ভব নয়। এটি একটি বহুমুখী সমস্যা যা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা দাবি করে। মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, এবং সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
১. সরকারের ভূমিকা:
সরকারের উচিত একটি নীতি ও আইন প্রণয়ন করা যা মিডিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে, যাতে তারা সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে কনটেন্ট তৈরি এবং প্রচার করে।
২. মিডিয়া সংস্থার দায়িত্ব:
মিডিয়া সংস্থাগুলি এই প্রেক্ষাপটে বিশাল দায়িত্ব পালন করে। তারা যে ধরনের ছবি বা ভিডিও প্রচার করে, তা সমাজে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের ভূমিকা:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সকল অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরও এই সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
৪. প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার:
বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৫. সামাজিক দায়িত্বশীলতা এবং একযোগী প্রচেষ্টা:
এই সমস্যা মোকাবিলায় শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা মিডিয়া সংস্থাগুলি নয়, সাধারণ জনগণও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৬. বহির্বিশ্বের অভিজ্ঞতা এবং উদাহরণ:
বিশ্বের নানা দেশে এই ধরনের ছবি ও কনটেন্টের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যা আমাদের দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় দেশগুলো এবং আমেরিকায় মিডিয়া সংস্থাগুলির জন্য কড়া আইন এবং গাইডলাইন রয়েছে, যা তাদের নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রতি গুরুত্ব দেয় এবং সঠিক কনটেন্ট প্রকাশে উৎসাহিত করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের ছবি বা কনটেন্টের কারণে ক্ষতি সৃষ্টির পর সেগুলির পর্যালোচনা করা এবং রিভিউ করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। এতে এই ধরনের কনটেন্ট প্রকাশের আগে তা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং চিকিৎসাগত বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, হিংসাত্মক বা বিভৎস ছবি দেখার ফলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষত, শিশু এবং তরুণদের উপর এর প্রভাব অনেক বেশি, কারণ তাদের মস্তিষ্ক এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হয়নি এবং তারা পৃথিবীকে বিভিন্নভাবে অনুভব করে এবং বিচার করে। এই ধরনের ছবি মস্তিষ্কের একাধিক অংশের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, যা তাদের মানসিক অবস্থা খারাপ করে দেয়।
১. মানসিক প্রভাব এবং মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া:
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, হিংসাত্মক বা বিভৎস ছবি মানুষের মস্তিষ্কের সেগমেন্টগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, এই ধরনের ছবির সাথে সম্পর্কিত অনুভূতিগুলি মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা (যা মূলত অনুভূতি, বিশেষ করে ভয় এবং উদ্বেগকে প্রক্রিয়াজাত করে) এবং প্রিফ্রন্টাল করটেক্স (যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী) এর মধ্যে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যকলাপ সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে, মানুষ দীর্ঘসময় ধরে উদ্বেগ, দুঃখ বা ভীতি অনুভব করতে পারে।
২. শিশুদের উপর প্রভাব:
শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ এমনভাবে হয় যে, তারা প্রাপ্ত তথ্য ও অভিজ্ঞতার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। যখন তারা সহিংস বা বিভৎস ছবি দেখে, তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ধরনের ছবি দেখলে শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক, আক্রমণাত্মক আচরণ এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এই প্রভাবগুলো তাদের সৃজনশীলতা, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং সামাজিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৩. দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগের ঝুঁকি:
হিংসাত্মক বা বিভৎস ছবি শিশু এবং তরুণদের মধ্যে মানসিক সমস্যার ঝুঁকি তৈরি করে, যা তাদের জীবনের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান সমস্যাগুলো হলো: