মঙ্গলবার- ৮ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ -২৫শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ English Version

চিরিরবন্দরে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাগজ ব্যবহার করে নকল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ

চিরিরবন্দরে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাগজ ব্যবহার করে নকল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ

মোরশেদ উল আলম, চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি: দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাগজপত্রাদি কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে নাম পরিবর্তন করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছেন জনৈক আওয়ামীলীগ নেতা নকল মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘদিন পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাড়িতে ফিরে আসলে এলাকায় তোলপাড় শুরু এবং বিষযটি জানাজানি হয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ করেও মর্যাদা বঞ্চিত হয়েছে তাদের মধ্যে একজন হলেন মোঃ আলম ওরফে চেমরু। ডাক নাম চেমড়–। গত ১০ নভেম্বর/২৪ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলম চেমড়– প্রকৃত তথ্য উল্লেখ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাগজ ব্যবহার করে নকল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ করে সুবিচার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।

তিনি উপজেলার ফতেজংপুর ইউনিয়নের বড় হাশিমপুর গ্রামে এক গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত. খড়কু মোহাম্মদ ও মৃত. গোলাপি বেগমের ৮ সন্তানের মধ্যে আলম ওরফে চেমড়ু সবার বড়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এলাকার কয়েকজনকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যেতে দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেন নি। তাই তিনিও তার বাবা-মাকে না জানিয়ে দেশ-মাতৃকার টানে চুপিসারে একই এলাকার মৃত. মফিজ উদ্দিন এর ছেলে মোঃ নুরুল ইসলামের সাথে ভারতে পাড়ি জমান এমন সময় ট্রেনিং শেষ করে ওই এলাকার শামসুল হক ওরফে হুমায়ুন কবির, আশরাফ আলী, ইদ্রিস আলী (কালীগঞ্জ, চিরিরবন্দর) সহ আরও অনেকে ট্রেনিং থেকে ফেরার পথে দেখা হয় আলমের সাথে। পথিমধ্যে দেখা হওয়ায় এবং অস্ত্র সরবরাহে লোকবল কম থাকায় তাকে সাথে নিয়ে চলে আসে শামসুল হক ও আশরাফ আলী এবং ইদ্রিস আলী। তাকে তারাই ট্রেনিং দিবে বলে আশস্ত করে। ফলে আলম রাজী হয় এবং চলে আসে। পরবর্তীতে তিনি উক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি রাবেয়া মোড় থেকে দশমাইল পর্যন্ত কয়েকটি ব্রিজ স্থলমাইন দিয়ে ভেঙে দেয়ার সময় সাথে ছিলেন এবং অস্ত্র সরবরাহ করেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া অস্ত্র দিয়ে চম্পাতলি বাজারের পশ্চিম দিকে সাতাশজান ব্রিজে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে তাদের অপারেশন লিডার তোরাব আলী ও ইদ্রিস আলী চিরিরবন্দরে রেলব্রিজ ভাঙ্গার সময় আহত হলে তাঁদেরকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাকি সময় শামসুল হকের সাথে তিনি যুদ্ধ করেন। তখন আরও নতুন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে প্রশি¶ণ শেষে তাদের সাথে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলে তারা সবাই অস্ত্র জমা দিয়ে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। অন্যদিকে নুরুল ইসলাম যুদ্ধে যোগদান না করে ব্যবসার কাজে ভারতে থেকে যান এবং ব্যবসার কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। আলম ভারতে ট্রেনিংয়ের কাগজ না পেলেও অস্ত্র জমা দিয়েছিল শামসুল হক ওরফে হুমায়ুন কবির এবং আশরাফ আলীর সঙ্গে এবং অস্ত্র জমার কাগজ নিজ নিজ নিয়ে নেয়। এরপর বাসায় এসে আলম তার জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে বেড়াতো। এরপর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রেশন দেয়া হয় সেসময় শামসুল হক মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলম চেমড়–কে ডেকে তার কাছ থেকে অস্ত্র জমার কাগজ নিয়ে নেয় এবং তাকে অনুদান দেয়ার জন্য আশস্ত করে। ফলে সরলমনা আলম গরীব অসহায় হওয়ায় কিছু অনুদানের আশায় তা দিয়ে দেয়। এরপর আলমের কাছ থেকে কিছু অর্থ হিসেবে দাবি করে অন্যথায় কাজটি হবে না বলে জানিয়ে দেয়। হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে আলম চেমড়– টাকা দিতে না পারায় তাকে পরে কিছু দেয়া হবে এবং তার নাম মুক্তিযোদ্ধার খাতায় লিখে দিবে বলে আশস্ত করে। পরবর্তীতে তিনি কিছু না পাওয়ায় পাড়ি জমান জীবিকার অšে^ষনে চট্টগ্রামে। এরপর সুদীর্ঘ ২৫ বছর পরে গ্রামে ফিরে এসে দেখে তার নাম ব্যবহার করে অন্য আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তুলেছে। অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আলম চেমড়– কিছুই জানে না। যিনি মুক্তিযোদ্ধা আলমের নাম ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন তিনি মূলত কোনো যুদ্ধই করেননি। বরং যুদ্ধের সময় তিনি ফতেজংপুর ইউনিয়নের দেবিগঞ্জ বাজারে দর্জির কাজ করতেন এবং ঘরজামাই ছিলেন। তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আবার বিয়ে করেন বড় হাশিমপুর গ্রামে নাজি পাড়ায়। ২য় বিয়েটি যুদ্ধের কয়েক বছর পরে করেছেন এবং প্রথম এই এলাকায় বসবাস শুরু করেছেন। উল্লেখ্য তিনি একজন রিফিউজি হিসেবে ওই এলাকায় এসেছেন। তিনি ওই এলাকায় আলম খলিফা নামে পরিচিত। তার প্রকৃত নাম মোশাররফ হোসেন কিন্তু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আলম নাম ধারণ করেন যাতে আলম ওরফে চেমড়ু কখনো নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে না পারে। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মোশাররফ হোসেন নামে তালিকাবদ্ধ হয়েছেন (মুক্তিবার্তা নং ০৩০৮০৭০১৯৮)। জানা যায় মোশাররফ হোসেন ওরফে আলম খলিফা তৎকালীন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সহায়তায় ইউনিয়ন কমান্ডারের সুপারিশে লাল মুক্তিবার্তায়ও তালিকাভুক্ত হয়েছেন। যা নিয়ে ওই এলাকায় প্রায়শই কথা ওঠে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আলম খলিফার বিরুদ্ধে। বিষয়টি আগেই টের পেয়ে অনেকবার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ঠিকানা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন বিগত সময়ে। অন্যদিকে ইউনিয়ন কমান্ডার শামসুল হক ও মোশাররফ হোসেন আলমের আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় ওই এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। এরপর বারবার ইউনিয়ন কমান্ডার শামসুল হক ওরফে হুমায়ুন কবিরকে বললেও তিনি আশস্ত করেন আগের মতোই। হতদরিদ্র মানুষটির কাছে আবারও অর্থ দাবি করে যেটা দিতে তিনি তখনও অপারগতা প্রকাশ করেন এবং আশাহত হয়ে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জীবিত মুক্তিযোদ্ধা ও বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক মানুষ আছেন যারা ¯^চ¶ে দেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলম ওরফে চেমড়ু কে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাঁদের দাবি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া হোক আর অমুক্তিযোদ্ধাকে বাদ দেয়া হোক। বর্তমানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সবখানেই বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা চলছে।
এ ব্যাপারে জানতে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ মমিনুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু তার কোন কাগজপত্রাদি নাই। অস্ত্র জমা দেয়ার কাগজ সম্পর্কে তার কোন জানা নাই। এলাকায় অনেকদিন না থাকায় তার সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেহা তুজ জোহরা বলেন, অভিযোগের আলোকে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও কার্যাদি করা হবে।
এলাকাবাসি ও জীবিত বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলম চেমড়–র বিষযটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত পুর্বক সত্যতা উদঘাটন করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

বার ভিউ হয়েছে
0Shares

COMMENTS